পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বেসামরিক আমলাদের প্রভাব উল্লেখ কর।

অথবা, পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বেসামরিক আমলাদের প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পাকিস্তান সৃষ্টি থেকেই বেসামরিক আমলাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে আমলাতন্ত্র প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের কেন্দ্র ও প্রদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কেন্দ্রীয় আমলাদের নিয়োগ করা হয়। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী অতিমাত্রায় আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় প্রথম দশকে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব ও অবস্থান সুদৃঢ় হয়।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেসামরিক আমলাদের প্রভাব : পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনের প্রথম থেকেই প্রদেশে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব দেশটির রাষ্ট্রীয় জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাদের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তারা জনগণের সেবা করার পরিবর্তে জনগণের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। নিচে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেসামরিক আমলাদের প্রভাব বর্ণনা করা হলো :
১. সামাজিক পদমর্যাদা ও প্রভাব : পাকিস্তানের বেসামরিক আমলাগণ উচ্চ পদমর্যাদা ভোগ করতো। পাকিস্তানে সি এস এস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসনে সিভিল সার্ভেন্ট অব পাকিস্তান (সিএস পি) নিয়োগ করা হতো। সি এস পি কর্মকর্তাদের এক বছর সার্ভিস একাডেমিতে এবং একবছর ক্যাম্ব্রিজ অথবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ শেষে সাবডিভিশনাল অফিসার বা মহকুমা প্রশাসক পদে মহকুমায় নিয়োগ করা হতো। ৮ থেকে ১০ বছরের অভিজ্ঞতার পর তাদের ডেপুটি কমিশনার পদে পদোন্নতি দেওয়া হতো। সি এস পি অফিসারদের জন্য ৬০% আন্ডার সেক্রেটারি, ২/৩ অংশ ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং সেক্রেটারির পদ সংরক্ষিত ছিল। তাদের বেতন ছিল সর্বোচ্চ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও ছিল প্রচুর।
২. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব : পাকিস্তানে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল না। ফলে তারা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বেসামরিক আমলাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।
৩. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব : পাকিস্তানের বেসামরিক আমলাগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল ১৯৪৭ সালে যেসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় আসীন হন। তাদের সমর্থন ক্ষেত্রে বা গ্রহণযোগ্যতা ছিল খুবই কম। এর প্রধান কারণ ছিল ভারত। অনেক নেতার মূল বাসস্থান ছিল ভারতে। ফলে পাকিস্তানে তাদের নিজস্ব এলাকা ও সমর্থনের ভিত্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
৪. কেন্দ্রীয় সরকারের উপর প্রভাব : পাকিস্তানের শুরু থেকে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী বেসামরিক আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রে বেসামরিক আমলাদের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে কাদিয়ানী আন্দোলনের সময় পঞ্চাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও দৌলতানা মন্ত্রিসভা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এছাড়া ১৯৫৪ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিতে ক্ষমতা মূলত আমলাদের হাতে চলে যায়। গোলাম মোহাম্মদ ও ইস্কান্দার মীর্জা উভয়ে ছিলেন বেসামরিক আমলা।
৫. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার প্রভাব : পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ ও আইন পরিষদ থাকলেও
মূল দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত আমলাদের তথা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রতি কোনো গুরুত্বারোপ না করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদ ের উপরই নির্ভর করেন। যা পাকিস্তানে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল।
৬. স্থায়ী পদমর্যাদা : মন্ত্রীরা অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান। তারা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু আমলারা বরাবর থাকেন। ফলে তাদের দায়িত্ব ও কার্যবিধি অনেক বেশি। যা পাকিস্তানে বেসামরিক আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল।
৭. সামাজিক আধিপত্য : পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন শুরু থেকেই ছিল অস্থিতিশীল। বিভিন্ন দল, উপদলে কোন্দল ও চক্রান্ত সর্বদা লেগে থাকত। এসব দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিরসনে আমলারা সবসময় আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন।
৮. উন্নয়নে প্রভাব : পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল এলিট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হাতে। যারা ছিল প্রভাশালী পরিবারের সদস্য। তারা পাকিস্তানের উন্নয়নে প্রভাব বিস্তার করতো।
৯. পরিবর্তনের রূপকার : পাকিস্তানের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম রূপকার ছিলেন বেসামরিক আমলাগণ। ফলে আমলাদের প্রভাব সুদৃঢ় হয়।
১০. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া : আইন প্রণয়নে আইনের খসড়া প্রস্তুত পার্লামেন্টের আলোচনা ও সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে পাকিস্তানের বেসামরিক আমলারা প্রভাব বিস্তার করে থাকত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের বেসামরিক আমলাগণ ছিলেন প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। তাদের সাথে জনগণের তেমন যোগাযোগ ছিল না। তারা নিজেদের উচ্চ শ্রেণি হিসেবে মনে করতো যার ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে জনগণ কোনো সুফল পেত না। আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতার অন্যতম কারণ হলো পাকিস্তান ভাঙনে। ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত।