অথবা, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কাঠামোর কার্যাবলি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রাদেশিক সরকার কাঠামো সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রাদেশিক সরকার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাদেশিক সরকার কাঠামো : প্রাদেশিক শাসনক্ষমতা অর্পণ করা হয় প্রাদেশিক গভর্নরের উপর এবং তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। গভর্নর প্রেসিডেন্টের অনুকূলে কার্যসম্পাদন করতেন। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গভর্নরকে সহায়তা করতো। প্রাদেশিক পরিষদের মধ্য থেকে পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন পুষ্ট ব্যক্তিকে মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করতেন এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিযুক্ত করতেন। গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, মুলতুবি অথবা ভেঙে দিতে পারতেন। এছাড়া এডভোকেট জেনারেল ও প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন এর সদস্য ও চেয়ারম্যান নিয়োগ করেন গভর্নর।
পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার কাঠামো ও কার্যাবলি : ১৯৫৬ সালের সংবিধান এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রাদেশিক সরকার সম্পর্কে কাঠামো ও ক্ষমতা বণ্টিত হয়। নিচে বর্ণনা করা হলো :
১. প্রাদেশিক গভর্নর : পাকিস্তানের প্রাদেশিক শাসনভার অর্পণ করা হয়েছিল গভর্নরের উপর। প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে গভর্নর প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত ছিলেন। প্রাদেশিক গভর্নর প্রেসিডেন্টের নির্দেশে প্রেসিডেন্টের অনুকূলে কার্যসম্পাদন করতেন। তার এ কাজে তাকে একটি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা সহায়তা করতো। গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদের
মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিকে মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করতেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ ক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিযুক্ত করতেন। গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, মুলতুবি অথবা ভেঙে দিতে পারতেন। গভর্নরের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিল আইনে পরিণত হতো না।
২. মন্ত্রিসভা : মুখ্যমন্ত্রী তার সহযোগী মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করতেন। প্রাদেশিক শাসন পরিচালনায় ক্ষেত্রে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল। মন্ত্রিসভা গভর্নরের অনুকূলে কার্যাবলি পরিচালনা করতো। প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটত।
৩. প্রাদেশিক আইনসভা : প্রাদেশিক আইনসভা ছিল এককক্ষ বিশিষ্ট। প্রাদেশিক পরিষদ ৩০০ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় প্রাদেশিক আইনসভা। প্রাদেশিক পরিষদে ১০ বছরের জন্য ১০টি নারী আসন সংরক্ষিত থাকে। ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রত্যেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৫৫ এ নামিয়ে আনা হয়। এর মধ্যে ৫টি ছিল সংরক্ষিত নারী আসন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতো।
৪. প্রাদেশিক সচিবালয় : প্রাদেশিক সচিবালয় ছিল প্রশাসনিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। প্রাদেশিক সচিবালয়ে ছিলেন প্রাদেশিক মন্ত্রী। প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন সচিব। কয়েকটি বিভাগ, ডিভিশন ও শাখায় বিভক্ত ছিল প্রাদেশিক মন্ত্রণালয়। প্রাদেশিক সচিবালয়ের মুখ্য সচিব ছিলেন একজন যিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সমন্বয় তত্ত্বাবধায়ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ করতেন।
৫. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৩৫ সালের সংবিধানের অনুরূপ। ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুসারে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। ১৯৫৬ সালে ১. ফেডারেল তালিকা; ২. প্রাদেশিক ত
ালিকা; ৩. সহ
তালিকা। সংবিধানে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যুদ্ধ ও মুদ্রাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ফেডারেল তালিকা।
৬. অর্থনৈতিক উৎস : বহিঃশুল্ক, আবগারি শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক, আয়ব্যয় কর, ক্রয়-বিক্রয় কর, নৌ, বিমান বন্দর টারমিনাল কর, খনিজ তৈল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর কর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ উৎসগুলো কেন্দ্রের হাতে রাখা হয়। কৃষি আয়সহ অন্যান্য বিষয়ে আয় ছিল প্রদেশের উপর। দেশের ভিতর ও বাহির থেকে ঋণ সংগ্রহের ক্ষমতা রাখা হয় কেন্দ্রীয়
সরকারের উপর।
৭. মুদ্রা ব্যবস্থা : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করে। দুই অঞ্চলের জন্য চালু হয় দুটি স্বতন্ত্র স্টেট পব্যাংক।
৮. প্রাদেশিক আইন : পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং প্রাদেশিক আইনসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনসভাকে সার্বভৌম অধিকার দেওয়া হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্যতম প্রধান অঙ্গ। প্রাদেশিক গভর্নর এর অধীনে থেকে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় বাবস্থায় প্রাদেশিক সরকার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।