পর্যবেক্ষণের শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ কর।

অথবা, শ্রেণিভিত্তিক পর্যবেক্ষণ আলোচনা কর।
অথবা, পর্যবেক্ষণের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সামাজিক গবেষণায় উপাত্ত সংগ্রহের একটি প্রাচীন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হচ্ছে পর্যবেক্ষণ। এটি সকল বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিস্বরূপ। কেননা বিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে মূলত পর্যবেক্ষণ থেকেই। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষক গবেষণার পরিবেশ অর্থাৎ সামাজিক অবস্থাকে কোনরূপ বাধাগ্রস্ত বা প্রভাবিত না করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার আচরণ, রীতিনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, প্রথা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও অবিকৃত উপাত্ত সংগ্রহ করে থাকেন।
পর্যবেক্ষণের শ্রেণিবিভাগ : বিভিন্ন সমাজ গবেষক বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণকে ভাগ করেছেন। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো :
১. কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ : পর্যবেক্ষণীয় ঘটনা প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ কালে বিভিন্ন অবস্থা পরিস্তিকরণ এবং ধারণাযোগ্য তথ্যাবলির শ্রেণিকরণে সতর্ক পরিকল্পনার অধীনে কাঠামোবদ্ধ পর্যবেক্ষণের কাজ পরিচালনা করা হয়। ঘটনার সুশৃঙ্খল বর্ণনা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রধানত এ ধরনের পর্যবেক্ষণ করা হয়। কাঠামোগত পর্যবেক্ষণে
দরকারি তথ্যসংগ্রহের জন্য চেকলিস্ট, ফরমেট ও প্রাসঙ্গিক যন্ত্রপাতি যেমন- ক্যামেরা, টেপ রেকর্ডার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এখানে পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। মোটকথা পর্যবেক্ষণের প্রায় সমস্ত গুণই এখানে বিদ্যমান। একে কাঠামোবদ্ধতার তারতম্য বিবেচনায় দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা : পরিপূর্ণ ও আংশিক কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ ।
২. কাঠামোহীন পর্যবেক্ষণ : কাঠামোগত পর্যবেক্ষণের বিপরীত অবস্থা হলো কাঠামোহীন পর্যবেক্ষণ। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় কাঠামোহীন পর্যবেক্ষণ একটি প্রধান কৌশল। গবেষক সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি সমাধান করে বল অনেকে একে সাধারণ পর্যবেক্ষণও বলে থাকেন। সাধারণ পরিবেশের মধ্যকার একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বেছে নিয়ে এর পারস্পর্যতা ও তৎপরতা এখানে ধারণ করা হয়। ঘটনার উপর পর্যবেক্ষণের নিয়ন্ত্রণ না রেখে ঘটনার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজনীয় সাড়া দেয়। এজন্য এ পদ্ধতিতে অতি সহজ উপায়ে ঘটনার মধ্যকার সহজাত ও স্বাভাবিক অবস্থা ধারণ করা সম্ভব হয়। পর্যবেক্ষক এখানে ঘটনার সংখ্যা, ঘটনাকাল এবং এর শুরু ও শেষ নির্ণয়ের মাধ্যমে সামগ্রিক অবস্থা পরিমাপ করেন, যাতে করে সমজাতীয় অন্যান্য ঘটনার সাথে তুলনা করা যায়।
৩. নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ : সামাজিক ঘটনার পরিমাপযোগ্য তথ্যসংগ্রহ করার একটি অন্যতম পদ্ধতি হলো নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ । পর্যবেক্ষক এখানে পূর্বপরিকল্পিত কৌশল ব্যবহার করে বলেন পর্যবেক্ষণ প্রায় সবটাই কাঠামোবদ্ধ হয়। এখানে কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে কিংবা পরিবেশকে অধিক মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়। মূলত পরীক্ষণ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এখানে পর্যবেক্ষককে পক্ষপাতমুক্ত থাকতে হয় এবং কাজ সম্পূর্ণ
উদ্দেশ্যভিত্তিক করতে হয়। W. J. Goode এবং P. K. Hatt বলেছেন, “একজন সমাজ গবেষকের পক্ষে অনুসন্ধানাধীন ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যথেষ্ট কঠিন কাজ হলেও অন্তত নিজেকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।”
৪. অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ : অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রাথমিক স্তর হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । এ পদ্ধতিতে বাইরের নির্দেশ নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রভাবমুক্ত থেকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বা বাস্তবিক পরিবেশে বিষয় বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এখানে পর্যবেক্ষক সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও ঘটনা তৎপরতার ক্ষেত্রে উপস্থিত বা প্রভাব
বিস্তারকারী উপাদানগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে ঘটনার স্বাভাবিক গতিতে কোন হস্তক্ষেপ করা হয় না।
৫. সরাসরি অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ : দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপনের সাথে সরাসরি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে৷ কোন গবেষক যখন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান নিয়ে নানা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে তার গবেষণা কাজ পরিচালনা করেন তাকে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ বলা হয়। Leonard Bickman এটাকে আংশিক কাঠামোবদ্ধ পর্যবেক্ষণ বলে উল্লেখ করেন। G. J. MacCall এবং J. K. Simmons বলেছেন, “অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ একটিমাত্র পদ্ধতি নয়, বরং এটি একাধিক পদ্ধতি ও কৌশলের সংমিশ্রণ।”
৬. অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণ : Wilkinson and Bhandarker বলেছেন, “পর্যবেক্ষণীয়দের কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোনপ্রকার অভিজ্ঞতা ছাড়াই পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে যখন কোন বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ এবং ধারণকারীর ভূমিকা গৃহীত হয়, তখন তাকে অংশগ্রহণহীন পর্যবেক্ষণ বলে।” পর্যবেক্ষণের এ ধরনের অংশগ্রহণহীনতা যে কোন অবস্থাতেই ঘটতে পারে। এখানে পর্যবেক্ষক সম্পূর্ণ গোপন অথবা তথ্যসংগ্রহকারী হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারেন। কিন্তু দলীয় কাজে তিনি নিযুক্ত হন না। কিছু কিছু সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে এ পদ্ধতি একমাত্র উপযোগী হিসেবে বিবেচিত। যেমন- কোন অপরাধী দলের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির বিভিন্ন প্রকারভেদের কারণে এটাই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। কেননা সমাজ গবেষণায় কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।