পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে পরীক্ষণ পদ্ধতির অবদান ব্যাখ্যা কর।

অথবা, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান বলতে কী বুঝ? মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে আনয়ন করতে পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান কী? মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উপনীত করতে পরীক্ষণ পদ্ধতির ভূমিকা লিখ।
অথবা, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও। মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত বা উপনীত বা আনায়ন করতে পরীক্ষণ পদ্ধতির অবদান লিখ।
উত্তর।। ভূমিকা : পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের সূচনা হয় প্রায় একশত বছর পূর্বে। এটি দার্শনিক মনস্তত্ত্বের প্রতিবাদস্বরূপ। ১৮৭৯ সালে মনোবিজ্ঞানী ড. উইলহেম উন্ড জার্মানির
লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগার স্থাপন করেন। সে সূত্রে বলা যায়, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা তখন থেকেই শুরু । তবে অল্প সময়ের মধ্যে এ বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিধি অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাছাড়া বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞান বিকাশে পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান : পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান বলতে মনোবিজ্ঞানের সে শাখাকে বুঝায়, যে শাখায় পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ ও প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাবলিকে সুসংবদ্ধভাবে সন্নিবিষ্ট করা হয়। অর্থাৎ, পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত আচরণ সম্পর্কিত তথ্য ও তত্ত্বের সমাহার হল পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে নিয়ে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীর মতবাদ দেওয়া হল :
মনোবিজ্ঞানী রডিজার এবং অন্যান্যরা বলেছেন, “পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান সেসব ক্ষেত্রকে আওতাভুক্ত করে, যেখানে পেশাদারগণ আচরণ ও মানসিক জীবন অনুধ্যানের পরীক্ষণের উপর একচেটিয়া নির্ভর করে। এটি মূলত আচরণের জৈবিক ভিত্তি, প্রাণী শিক্ষণ এবং আচরণ এবং জ্ঞানীয় প্রক্রিয়াসমূহ (প্রত্যক্ষণ, স্মৃতি, ভাষা, চিন্তন) অনুধ্যান অন্তর্ভুক্ত করে।”
মনোবিজ্ঞানী ক্রাইডার এবং অন্যান্যরা বলেছেন, “পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের বিশেষত্ব হল যে, এটি মৌলিক মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যেমন সংবেদন ও প্রত্যক্ষণ, প্রেষণা ও আবেগ, শিক্ষণ, স্মৃতি এবং পরিজ্ঞানকে বিবেচনা করে।”
সুতরাং, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞান হল একটি স্বতন্ত্র মনোবিজ্ঞান। এ শাখা শুধু পরীক্ষণ পদ্ধতিতেই তথ্য সংগ্রহ করে।
আচরণের জৈবিক ভিত্তি, সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, শিক্ষণ, চিন্তন, পরিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের পরীক্ষণ পরিচালনা করা পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ।
মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীতকরণে পরীক্ষণ পদ্ধতির অবদান বা ভূমিকা : মনোবিজ্ঞানকে প্রথম পর্যায়ে বিজ্ঞান বলা হতো না। একে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। পরবর্তীতে যখন মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, তখন একে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যেসব বৈশিষ্ট্যের জন্য মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে প্রমাণ করা হয়। বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব প্রমাণের জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন তা হল চলের নিয়ন্ত্রণ, যেমন- পুনঃপুন পর্যবেক্ষণ, সামান্যীকরণ এবং যথার্থতা প্রতিবাদন।
মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে পরীক্ষণ পদ্ধতির অবদান বা ভূমিকা যে অপরিসীম তা প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা আবশ্যক। মনোবিজ্ঞানী উডওয়ার্থ ও শুজবাগ পরীক্ষণ পদ্ধতির চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা :
ক. ইচ্ছামতো চলের নিয়ন্ত্রণ,
খ. পুনরুৎপাদনশীলতা এবং
গ. যথার্থতা প্রতিপাদন,
ঘ. প্রণালীবদ্ধ অবস্থার পরিবর্তনকরণ।
নিম্নে পরীক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হল :
১. পুনরাবৃত্তিতা : পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পুনরাবৃত্তিতা। বিজ্ঞানীগণ কখনও একটিমাত্র পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হন না। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে গবেষক পরীক্ষণের বিষয়টি নিজে সৃষ্টি করেন। এজন্য তিনি যতবার প্রয়োজন, ততবারই তা পরীক্ষণ করতে পারেন। কেননা, পুনঃপুন পরীক্ষা করে ফলাফল যাচাই করার সুবিধা থাকায় পরীক্ষণের দ্বারা উপনীত সিদ্ধান্ত তুলনামূলকভাবে নির্ভুল ও নির্দিষ্ট হয়। তাই মনোবিজ্ঞানকে পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে বারবার গবেষণা করে প্রমাণ করা হয়েছে এটি বিজ্ঞানের একটি বিষয়।
২. ইচ্ছামতো চলের নিয়ন্ত্রণ: পরীক্ষণ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য চলের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে গবেষক ইচ্ছা করলে যে কোন সময় একটি বিশেষ নিরপেক্ষ চলের সৃষ্টি করে দেখতে পারেন। এটি সাপেক্ষ চলের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে গবেষক গবেষণার বিষয়টি ইচ্ছামতো সৃষ্টি করতে পারেন। চলের হ্রাস-বৃদ্ধি কখনও কতকগুলো চলকে অপরিবর্তনীয় রেখে আচরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অথবা একটি বিশেষ নিরপেক্ষ চল এর নিয়ন্ত্রণ করে আপেক্ষিক চল এর উপর তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া বাহ্যিক চলের প্রভাবেও নির্ভরশীল চলের পরিবর্তন হয়ে থাকে। এজন্য মনোবিজ্ঞানীগণ বাহ্যিক চলকে নিয়ন্ত্রণ করেও গবেষণাকার্য সম্পাদন করেন।
৩. যথার্থতা : পরীক্ষণ পদ্ধতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল যথার্থতা। এজন্য মনোবিজ্ঞানীগণ আচরণ সম্বন্ধীয় কোন ঘটনার উপর বারবার পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে একই রকম ফলাফল পাওয়া যায় কি না তা পর্যবেক্ষণ করেন।
বিজ্ঞানীগণ যখন তার গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন, তখন তিনি অন্যান্য বিজ্ঞানীর গবেষণার সাথে তার গবেষণার তুলনা করে যথার্থতা প্রতিপাদন করেন।
৪. নির্ভরশীলতা : অন্যান্য পরিবেশধর্মী পদ্ধতির তুলনায় পরীক্ষণ পদ্ধতি অধিক নির্ভরশীল। মনোবিজ্ঞানীগণ যে আচরণ পরিমাপ করবেন বলে স্থির করেন, পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে তা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, যা অন্য কোন পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না।
৫. সাধারণীকরণ : অল্পসংখ্যক দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করে একটি সাধারণ সত্যে উপনীত হওয়ার নামই সাধারণীকরণ।পৃথিবীর কোন পরীক্ষক বা গবেষকের পক্ষে সকল মানুষ বা প্রাণীর উপর গবেষণা চলানো সম্ভব নয়। তাই তিনি মানুষ ও প্রাণীর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক অংশের উপর পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে প্রাপ্ততথ্যের দ্বারা সকল মানুষ বা প্রাণী সম্পর্কে একটি সাধারণ সূত্র প্রয়োগ করেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে পরীক্ষণ পদ্ধতি বা পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের অবদান বা ভূমিকা অপরিসীম। পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ ও প্রাণী সম্পর্কে নিত্যনতুন তথ্য ও তত্ত্ব আবিষ্কার হচ্ছে, যার ফলে মানুষের কল্যাণে মনোবিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হচ্ছে।তাছাড়া মনোবিজ্ঞানের জ্ঞানকে অন্যান্য বিষয়েও প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে। কেননা, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ পরীক্ষালব্ধ সত্যে বিশ্বাসী, কোন কাল্পনিক সত্যে নয়। এজন্য বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীরা পরীক্ষণ পদ্ধতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।