অথবা, পরীক্ষণ বলতে কী বুঝ? পরীক্ষণে কার্য-কারণ সম্বন্ধের স্বরূপ ও সম্পর্ক নির্ণায়ক শর্তাবলি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, পরীক্ষণ বলতে কী বুঝ? পরীক্ষণে কার্য-কারণ সম্বন্ধের স্বরূপ ও সম্পর্ক নির্ণায়ক শর্তাবলি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রত্যেক বিজ্ঞানেই নিজস্ব বিষয়বস্তুর আঙ্গিকে তার অনুধ্যান বা গবেষণা পদ্ধতি নির্ভর করে।মনোবিজ্ঞান মানুষের আচরণ নিয়ে কাজ করে এবং এ আচরণের ধরনে রয়েছে ব্যাপকতা। তাই মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত পদ্ধতিসমূহেও রয়েছে ভিন্নতা ও ব্যাপকতা। এক্ষেত্রে কেবল একটি মাত্র পদ্ধতি ব্যবহার করে অনুধ্যান পরিচালনা সম্ভব নয়। এছাড়াও নতুন নতুন গবেষণা পদ্ধতির অনুসন্ধান ও তার প্রয়োগে মনোবিজ্ঞানীগণ সর্বদা সচেষ্ট।
পরীক্ষণ : সব ধরনের কাজকে বিচার করতে হয় একটি মানদণ্ডের সাহায্যে, যার প্রথম প্রান্তে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ এবং শেষ প্রান্তে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ। আমরা যতই প্রথম থেকে শেষ প্রান্তের নিকটবর্তী হতে পারবো ততই দৃঢ়তার সাথে গবেষণার মাধ্যমে কার্যকরণ সম্বন্ধ নির্ণয়ে সক্ষম হব।পরীক্ষণের স্বরূপ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য বেশকিছু মতামত লক্ষ্য করা যায়। সহজভাবে পরীক্ষণ হলো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কোনকিছুর পর্যবেক্ষণ করা। কোন কোন সমাজবিজ্ঞানী যেমন- Green Wood একে “as a method of
testing hypothesis” বলে উল্লেখ করেছেন।যোধা ও অন্যান্য (Jahoda and Others) এর মতে, “পরীক্ষণ হলো প্রমাণদি সংগ্রহের একটি সুসংবদ্ধ উপায়, যার মাধ্যমে কোন অণুকল্প যাচাই করা হয়।”
আর. পি. ফ্রেন্স (R. P. French) এর মতে, “We shall define a field experiment as a theoritically oriented research project in which the exprimental menufactures and independent variable in some real social setting in order to test some hypothesis.”
ফেস্টিনজার (Festinger) এর মতে, “The essence of an experiment may be described as observing the effect on a dependent variable of the manipulation of an independent variable.”
উপরিউক্ত আলোচানার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দক্ষতা সহকারে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নির্ভরশীল চলকের উপর স্বাধীন লক্ষ্য করা হলো পরীক্ষণ। তাই পরীক্ষণকে অনেক সময় ‘Controlled laboratory study’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। ‘নিয়ন্ত্রণ’ হচ্ছে পরীক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য এবং এ নিয়ন্ত্রণ হতে হবে অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে।
পরীক্ষণে কার্য-কারণ সম্বন্ধের স্বরূপ ও সম্পর্ক নির্ণায়ক শর্তাবলি : পরীক্ষামূলক গবেষণায় মূলত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কার্য-কারণ সম্বন্ধযুক্ত একটি অনুকল্প যাচাই করা হয়। একটি নির্দিষ্ট ঘটনা ‘ক’ সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হলো অন্য একটি
নির্দিষ্ট ঘটনা ‘খ’ । বিষয়টি এ ধরনের কার্য-কারণ সম্বন্ধযুক্ত অনুকল্পে ব্যক্ত করা হয়। এসব অনুকল্প যাচাই করার জন্য উপযুক্ত পরীক্ষামূলক নকশা প্রণয়ন করার প্রারম্ভেই কার্য-কারণ সম্পর্ক সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা নেয়া আবশ্যক।বিজ্ঞানে কার্য-কারণ সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। কার্য-কারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কারণ বলতে এমন একটি ঘটনাকে (ক)
বুঝান হয়, যা অন্য একটি ঘটনা (খ) ঘটাতে সাহায্য করে। এখানে উল্লেখ্য যে, সামাজিক বা মানবীয় আচরণের পিছনে একটি মাত্র কারণ উপস্থিত থাকে না; বরঞ্চ একাধিক কারণের প্রভাবেই একটি নির্দিষ্ট কার্য বা ঘটনা ঘটে থাকে। সেজন্য সংঘটিত কোন ঘটনার ‘Immediate cause’ চিহ্নিত করাই পরীক্ষণের মূল লক্ষ্য। পরীক্ষণে কোন একটি ঘটনার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত থাকে এবং সেসব শর্ত কিভাবে কাজ করে তা বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে আগ্রহী। নি েসেসব শর্ত সম্পর্কে আলোচিত হলো :
ক. আবশ্যকীয় শর্ত : এটি এমন একটি শর্ত, যা নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটালে সেখানে অবশ্যম্ভাবীরূপে উপস্থিত থাকে। যেমন- শ্রমিকরা শ্রমিক অসন্তোষের একটি আবশ্যকীয় শর্ত। এখানে শ্রম অসন্তোষ কখনোই দেখা দিবে না যদি সেখানে শ্রমিকরা উপস্থিত না থাকে।
খ. পর্যাপ্ত শর্ত : এটি এমন একটি শর্তকে বুঝায় যা একটি নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটাতে সক্ষম। যেমন— বাস্তবে অপটিক নার্ভ নষ্ট হয়ে গেলে অবশ্যই অন্ধত্ব ঘটবে।
গ. সহায়ক শর্ত : এটি এমন একটি শর্ত, যা কোন একটি ঘটনা ঘটাতে যে শর্তের দরকার হয় তাকে সাহায্য করে।
যেমন- কৈশোরে পরিবারের পিতার দৈহিক অনুপস্থিতি সন্তানের মাঝে মাদকাশক্তি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ঘ. আকস্মিক শর্ত : এটি এমন একটি বিষয়, যা কোন চলককে সহায়ক শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে সাহায্য করে।
যেমন- অনেক সময় দেখা যায় যে, কৈশোরে পরিবারে পিতার দৈহিক অনুপস্থিতির ফলে সন্তানের মাঝে মাদকাসক্তি দেখা দেয় না যদি না তার সঙ্গীরা ব্যাপক হারে নেশাদ্রব্য ব্যবহার করে। এখানে সঙ্গীদের আচরণ একটি আকস্মিক শর্ত।
ঙ. বিকল্প শর্ত : এটি হচ্ছে এমন সব অবস্থা, যা সম্মিলিতভাবে ঘটনা ঘটাতে সহায়তা করে। যেমন- উপরের উদাহরণে কৈশোরে পরিবারে পিতার দৈহিক অনুপস্থিতি অথবা শিশুর প্রতি পিতার অস্বাভাবিক আচরণ উভয়েই সন্তানের মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে। এসব শর্তই বিকল্প শর্ত হিসেবে বিবেচিত। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঠিক কারণ বা শর্তটি সংশ্লিষ্ট কার্যের আবশ্যকীয় ও পর্যাপ্ত শর্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও তা অন্যান্য শর্তের প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। তাই কোন কার্যের সঠিক কারণ নির্ধারণ কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া। ব্যবহারিক পর্যায়ে কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ধারণে তিনটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বিভিন্ন গবেষক উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো :
১. সহগামী ভেদ : অনুকল্পে উপস্থিত স্বাধীন চলক বা কয়েকটি নির্ভরশীল চলক যা কার্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকবে।অর্থাৎ কার্য ও কারণ একই যোগে পরিবর্তিত হবে, ঘটবে অথবা অনুপস্থিত থাকবে। যেমন- শিক্ষা ও আয় ইতিবাচকভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত লোকের আয় বেশি এবং যাদের শিক্ষার মান কম তাদের আয় কম। এখানে উল্লেখ্য, শিক্ষা ও আয়ের পারস্পরিক পরিবর্তন যদি সহগামী না হয় তবে সেগুলোকে কার্যকরী সম্পর্কে সম্বন্ধযুক্ত বলে চিহ্নিত করা যাবে না। সহগামী ভেদ ব্যবস্থার একটি বিশেষ বাহন হচ্ছে ‘তুলনায়ন’। গবেষক একই বিষয়ের পূর্বাপর অবস্থা তুলনা করতে পারেন। আবার সমজাতীয় বিষয়ের সাথে নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে তুলনা করতে পারেন। যেমন-ফুসফুসের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ধূমপানের প্রভাব জানার জন্য কোন গবেষক ধূমপায়ী ও অধূমপায়ীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের হার নিরূপণ করতে পারেন। আবার ধূমপায়ী ক্যান্সার রোগীদের ধূমপানের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করে তুলনা করতে পারেন।
২. কৃত্রিমতা মুক্ত : বিশ্লেষণাধীন চলকদ্বয়ের মধ্যকার সম্পর্কটি কৃত্রিমতা মুক্ত রাখার চেষ্টা করা গবেষকের একটি বিশেষ দায়িত্ব। এখানে কৃত্রিমতাহীনতা বলতে চলকদ্বয়ের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন চলক বা উপাদানের
অনুপস্থিতিকে বুঝান হয়। ব্যাপকার্থে আনুষঙ্গিক সকল উপাদানের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে সংশ্লিষ্ট নির্ভরশীল চলকের উপর স্বাধীন চলকের প্রভাব নিরূপণ করাই সম্পর্কের কৃত্রিমতাহীনতা। কৃত্রিমতাহীন সম্পর্ক চলকের মধ্যকার একটি সহজাত কার্য-কারণ সম্পর্কের ইঙ্গিত প্রদান করে এবং তা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। যেমন- কৃতিত্বের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রভাব অকৃত্রিমভাবে নিরূপণ করতে হবে প্রশিক্ষণার্থীর বয়স, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি চলকের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. ঘটনা সময়ক্রম : কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয়ে ও বিশ্লেষণে সময়ক্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এ ব্যবস্থায় গবেষক নিশ্চিত হতে চান যে, কার্যটি কারণের পরে সংঘটিত হয়েছে কি না। কেননা কারণ দ্বারা সৃষ্ট কোন কার্য কখনোই কারণের আগে ঘটতে পারে না। যেমন- হতাশা আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। এখানে আত্মহত্যা অবশ্যই হতাশাগ্রস্ত হবার পরে ঘটবে। তবে সামাজিক বিজ্ঞানে কার্য ও কারণ পরস্পরকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারে। যেমন- শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলে আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় আবার আয় বৃদ্ধি পেলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়। এমন অবস্থায় কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ণয় কঠিন কাজ। এসব ক্ষেত্রে ঘটনার সময়ক্রম নির্ধারণের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। ঘটনার সময়ক্রমের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, কার্য-কারণ সম্পর্কযুক্ত দু’টি উপাদানের একটি নির্ধারণী শক্তি ও অপরটি নির্ধারিত প্রতিক্রিয়া। এক্ষেত্রে নির্ধারণী শক্তিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে নির্ধারিত প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়। পরীক্ষণকে অনেক সময় ‘Controlled laboratory study’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। ‘নিয়ন্ত্রণ’ হচ্ছে পরীক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য এবং এ নিয়ন্ত্রণ হতে হবে অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে। তাই পরীক্ষণে কার্য-কারণ সম্বন্ধের স্বরূপ ও সম্পর্ক নির্ণায়ক শর্তাবলির গুরুত্ব মনোবিজ্ঞানে অস্বীকার করা যায় না।


