অথবা, পরীক্ষণ পরিকল্পনার বিভিন্ন ধাপ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পরিকল্পিতভাবে এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্দীপক উপস্থাপন করে প্রতিক্রিয়া পরিমাপ বা উপাত্ত সংগ্রহ করাকে পরীক্ষণ বলে। বিজ্ঞানে পরীক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম।মনোবিজ্ঞানে পরীক্ষণ বলতে আমরা সাধারণত পরীক্ষণ পদ্ধতির পরীক্ষণকে বুঝি থাকি। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে বিজ্ঞানী সুসামঞ্জস্যভাবে ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং সংগৃহীত উপাত্তের গাণিতিক বিশ্লেষণ করেন। বিজ্ঞানী পরীক্ষণ পাত্রের উপর অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করেন এবং এ অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করার ফলে যে নির্ভরশীল চল উৎপন্ন হয় তা তিনি পরিমাপ করেন।
পরীক্ষণ পরিকল্পনার ধাপসমূহ: পরীক্ষণ পরিকল্পনার জন্য বিজ্ঞানী কতকগুলো ধাপ অনুসরণ করেন, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. পরীক্ষণের নামকরণ: পরীক্ষণের নামকরণ সুস্পষ্টভাবে করতে হবে। সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানী যখন একটি পরীক্ষণ পরিকল্পনার চিন্তা ভাবনা করেন তখন তার কাছে যে বিষয়টি অতি জরুরি তা হলো পরীক্ষণের নাম নির্বাচন। পরীক্ষণের নামের মধ্যে এর উদ্দেশ্য, অনির্ভরশীল চল ও নির্ভরশীল চলের ইঙ্গিত থাকবে।
২. ঐতিহাসিক পটভূমি : বিজ্ঞানীকে পরীক্ষণ পরিকল্পনার সময় সমস্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে হয়। অতীতে কোন পরীক্ষণ পরিচালনার সাথে পরীক্ষণের যদি মিল থাকে তাহলে সে পরীক্ষণের প্রকল্প, চল, পরীক্ষণ পাত্র নির্বাচন, ফলাফল ইত্যাদির তুলনামূলক আলোচনা ও পাঠালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি ও একান্ত প্রয়োজন। প্রধান তিনটি কারণে পরীক্ষণের ধাপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যথা :
ক. পরীক্ষক অন্য গবেষকের অনুসন্ধান কার্যের পর্যালোচনা করে তার পরীক্ষণের সমস্যার বিবৃতি প্রদান করবেন।
খ. যদি অতীতে পরীক্ষণের অনুরূপ পরীক্ষণ পরিচালিত হয়ে থাকে তাহলে নতুন করে কেনা পরীক্ষণ পরিচালনা করতে হবে সেজন্য পরীক্ষক অনুসন্ধান কার্যের স্বপক্ষে যুক্তি দেখাবেন।
গ. অতীত গবেষণার পর্যালোচনা থেকে পরীক্ষক অবাঞ্ছিত চল সম্বন্ধে ধারণা পেতে পারেন এবং কিভাবে এ চলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল সে সম্বন্ধেও বুঝতে পারবেন।
৩. সমস্যা নির্ণয়করণ : পরীক্ষণ পরিচালনার অন্যতম প্রধান ধাপ হলো সমস্যা নির্ণয়করণ। পরীক্ষণের সমস্যা সম্পর্কে বিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ধারণা অর্জন করে থাকেন। বিজ্ঞানী সমস্যাকে কেন্দ্র করে তাদের গবেষণা শুরু করেন এবং সমস্যার সমাধান হলে তাদের অনুসন্ধান কাজ সম্পন্ন হয়।
৪. প্রকল্প প্রণয়ন : সমস্যার বর্ণনা করতে গিয়ে যেসব চল উল্লেখ করা হয় এক বা একাধিক যুক্তিযুক্ত উক্তির সাহায্যে এসব চল এর সম্ভাব্য সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। এরূপ উক্তিকেই বলা হয় প্রকল্প। তাই প্রকল্প প্রণয়ন পরীক্ষণ পরিচালনার
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
৫. চলের নিয়ন্ত্রণ : পরীক্ষণ পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো চলের নিয়ন্ত্রণ। চল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গবেষক সঠিকভাবে উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারেন। সেজন্য বিজ্ঞানী কতকগুলো নিয়ন্ত্রণকৌশল আরোপ করে পরীক্ষণের নির্ভরশীল চলকে অবাঞ্ছিত প্রভাব মুক্ত রাখেন।
৬. কার্য প্রণালি : পরীক্ষণের ধাপের মূল বক্তব্য হলো গবেষক কিভাবে পরীক্ষণ পরিচালনা সম্পন্ন করলেন তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবেন। এরূপ বর্ণনার মধ্যে পরীক্ষণের অনির্ভরশীল উপস্থাপন, নির্ভরশীল চলকে কিভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ থাকতে হবে।
৭. কার্যকরী সংজ্ঞা : পরীক্ষণে ব্যবহৃত বিভিন্ন চল সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। গবেষক পরীক্ষণের প্রতিটি চলের কার্যকরী সংজ্ঞা প্রদান করবেন।
৮. চল সনাক্তকরণ : চল সনাক্তকরণ ও পরীক্ষণের অন্যতম ধাপ। গবেষক পরীক্ষণের অনির্ভরশীল চল, নির্ভরশীল এবং অন্যান্য চলসমূহকে চিহ্নিত করবেন। গবেষক যে চলটি উপস্থাপন করেন সে চলটি হলো অনির্ভরশীল চল এবং পরীক্ষণ পাত্রের প্রতিক্রিয়া হলো নির্ভরশীল।সুতরাং চলসমূহকে চিহ্নিত করার পর গবেষক নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রয়োগ করেন।
৯. যন্ত্রপাতি : মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার পরীক্ষণ পরিকল্পনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ধাপ। মিরর ট্রেসিং যন্ত্র, মূলার-নায়ার কার্ড, স্মৃতি যন্ত্র, বিরাম ঘড়ি, অর্থহীন
শব্দ তালিকা ইত্যাদি দ্রব্যসামগ্রী মনোবিজ্ঞানের গবেষণার যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়।
১০. উপাত্ত বিশ্লেষণ : পরীক্ষণের সাহায্যে সংগৃহীত উপাত্তকে সাধারণত তথ্য গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্যে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে এরূপ বিশ্লেষণ যে কি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তা প্রত্যেকটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরই জানা আছে। সংগৃহীত উপাত্ত কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা নির্ণয়ে গাণিতিক বিশ্লেষণ মনোবিজ্ঞানীকে যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে।
১১. পরীক্ষণের নকশা : মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় বিভিন্ন ধরনের নকশা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব নকশা প্রণয়ন করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে এর মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ থাকে। যেমন— পরীক্ষণপাত্রকে বিভিন্ন দলে বণ্টন।অচেষ্টা সংখ্যা অনির্ভরশীল চলের উপস্থাপন এবং নির্ভরশীল চলের পরিমাপ।
১২. পরীক্ষনের সাহায্যে সংগৃহীত ফলাফল কতটুকু সাধারণীকরণ করা থাকে তা নির্ভর করবে জনসমষ্টিকে কতটুকু স্পষ্টভাবে আমরা নির্দেশ করেছি এবং পরীক্ষণের জন্য বাছাইকৃত নমুনা কী জনসমষ্টি প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে তার উপর। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি আমাদের পরীক্ষণের জন্য বাছাইকৃত নমুনার জনসমষ্টি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দেশ করি তাহলে নমুনার ক্ষেত্রে যে ফলাফল সত্য হবে তা হয়তো জনসমষ্টি সম্বন্ধে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পরীক্ষণ পরিকল্পনা মনোবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরীক্ষণের পদ্ধতি স্থিরকরনের পর পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষণ পরিচালনা পরীক্ষণ পাত্রের আবরণ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।কোন কোন পরীক্ষণে পরীক্ষণ পাত্রের আচরণের স্থায়ী লিপি সংগ্রহ করা সম্ভব।