পরীক্ষণমূলক নকশার প্রকারভেদ আলোচনা কর।

অথবা, পরীক্ষণমূলক নকশার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, পরীক্ষণমূলক নকশা কত প্রকার ও কী কী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যে কোন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করার জন্য নকশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নকশা ব্যতীত গবেষণা পরিচালনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা করার পূর্বশর্ত হিসেবে বা গবেষণা মধ্যবর্তী সময়ে নকশা প্রণয়ন এবং তার যথাযথ ব্যবহার করা খুবই প্রয়োজন। যখন একটি সমস্যাকে ঘিরে কোন গবেষণার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন সেই গবেষণা কমিটি কতকগুলো ধাপ অতিক্রম করে এবং গবেষণা শেষ পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। এসব ধাপগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো নকশা।
পরীক্ষণমূলক নকশা : গবেষণায় যখন পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে বলে পরীক্ষণমূলক নকশা। পরীক্ষণের চলগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক পরীক্ষণীয় নকশার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক ফলাফল পরীক্ষণ পরিচালনার মাধ্যমে পাওয়া যায়। পরীক্ষণ পদ্ধতিতে ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য গবেষণার ক্ষেত্রে একে ব্যবহার করা হয় বলে একে গবেষণার নকশা বলা হয়ে থাকে। তাই পরীক্ষণীয় নকশাই হচ্ছে হবেষণা বা পরীক্ষণমূলক নকশা।
সেলটিজ ও সহকর্মীবৃন্দ (১৯৬৫) বলেছেন, “গবেষণার (তথ্য পরীক্ষণের) নকশা বলতে বুঝায় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য পরিস্থিতি বা শর্তাবলির এমন একটি বিন্যাস যাতে পদ্ধতিগত মিতব্যয়িতার সাথে গবেষণার উদ্দেশ্যের
সমন্বয় ঘটে।”
কার্লিঙ্গার (১৯৭৮) বলেছেন, “কোন গবেষণার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এবং ভেদাঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য যে অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করা হয়,তার পরিকল্পনা, কাঠামো এবং কৌশলসমূহকে গবেষণার নকশা বলা হয়।”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো গবেষণার নকশা বা পরীক্ষণের নকশা একটি পরিকল্পনা, যাতে গবেষণার, প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে পর্যবেক্ষণের শর্তাবলি, উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের কৌশল ইত্যাদি নির্দেশিত হয়।
পরীক্ষণমূলক নকশার শ্রেণিবিভাগ : ম্যাক গুইগান (Mc, Guigan, 1978) পদ্ধতি ও প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে পরীক্ষণমূলক নকশাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
১. সরল দৈবচয়িত নকশা
২. দৈবচয়িত দুই দলীয় নকশা
৩. দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা
৪. উপাদানভিত্তিক নকশা এবং
৫. আন্তঃদলীয় নকশা।
১. সরল দৈবচয়িত নকশা : সরল দৈবচয়িত নকশা হলো অত্যন্ত সহজ ধরনের নকশা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দলের মধ্যে নমুনা বিতরণ ও তাদের উপর কর্ম সম্পাদনে কোন ব্যক্তিগত প্রভাবকে এড়ানো সম্ভব হয়। যদি একটি পরীক্ষণে দুটি দল থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে সরল দৈবচয়িত নকশা পদ্ধতিতে তাহাদের মধ্যে কার্য বণ্টন করা হয়। এ ধরনের নকশায় মূলত দুটি মৌলিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ দুটি পদ্ধতি হলো :
ক. লটারি পদ্ধতি ও
খ. দৈবচয়িত সারণি পদ্ধতি
ক. লটারি পদ্ধতি : লটারি পদ্ধতির মাধ্যমে যে কোন ধরনের লটারির কৌশল অবলম্বন করা হয়। যেমন- কয়েন ব্যবহার পদ্ধতি। একটি কয়েনকে উপরে ছুড়ে দেয়া হয় এবং ছুঁড়ে দেয়ার আগেই ঠিক করে নিতে হয় যে কয়েনের কোন পাশটি উপরের দিকে অবস্থান করবে, যখন তা মাটিতে পড়বে। কেননা এটা সম্পূর্ণই একটি দৈব ঘটনা।
খ. দৈবচয়িত সারণি পদ্ধতি : দৈবচয়িত সারণি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে নকশা অনুযায়ী নমুনা নির্বাচন ও কার্য সম্পাদন করা সম্ভব। দৈবচয়িত সারণিতে বহুসংখ্যক সংখ্যা সুন্দরভাবে কলাম ও সারিতে সাজানো থাকে। এই সংখ্যাগুলো মূলত ০ থেকে ৯৯ সংখ্যার মধ্যে অবস্থান করে এবং এগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমে ঠিক করা হয়। সংখ্যাগুলোর ক্রমবিচারে এদের অবস্থান সম্পূর্ণভাবে দৈবচয়িতা ও প্রাকৃতিক।
২. দৈবচয়িত দুই দলীয় নকশা : এ ধরনের নকশা মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় ও মৌলিক নকশা। দুই দলীয় নকশাকে অনেক সময় দুই দলীয় দৈবনমুনা ভিত্তিক” নকশাও বলা হয়।এই ধরনের নকশায় এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যেখানে দুইবার দৈবচয়িত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সর্বপ্রথম এই ধরনের পরীক্ষণের জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটি সমগ্রক (Population) নির্ধারণ প্রয়োজন। তাই সমগ্রক থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। নমুনার সংখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর নমুনা সংগ্রহে দৈবচয়িত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে— লটারির মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এটা হচ্ছে প্রাথমিক দৈবচয়ন। উক্ত নমুনা দলকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এরূপ ভাগ করণের ক্ষেত্রে দৈবচয়নের সাহায্য নেয়া হয়। দৈবচয়িত পদ্ধতিতেই পরীক্ষকদের দুটি দলে ভাগ করা হয় যাতে সমান সংখ্যক নমুনা বা পরীক্ষক থাকে। এভাবে দুই ধাপে দৈবচয়ন ব্যবহার করে নমুনার দুটি দল পাওয়া যায়, যা পরীক্ষণে ব্যবহার করা হয়।
৩. দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা : দুই দলীয় নকশায় দুটি পরীক্ষণমূলক অবস্থা থাকে, কিন্তু যখন তিনটি বা আরো বেশি পরীক্ষণমূলক অবস্থা বা উদ্দীপকের তিনটি মাত্রা বা কিংবা আরো বেশি সংখ্যক উদ্দীপক মাত্রাকে অনির্ভরশীল চল হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন বহুদলীয় নকশা ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন মনোবিজ্ঞানী জানতে চান বিভিন্ন পরিমাণের দীর্ঘসময়ের অনাহারের পর শিক্ষণের পার্থক্য ঘটে কি না অথবা বিভিন্ন পরিমাণের পুরস্কার শিক্ষণে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তার করে কি না অথবা বিভিন্ন ধরনের সংবেদী সংকেত ধাঁধা শিক্ষণে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তার করে কি না, শিক্ষণের পর বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বর্তী ক্রিয়া স্মৃতি-বিস্তৃতির পার্থক্য সৃষ্টি করে কি না? এমনি ধরনের বহুপরীক্ষণে মনোবিজ্ঞানীরা বহুদলীয় নকশা ব্যবহার করেন।বহুদলীয় নকশার যৌক্তিকতা হলো বিভিন্ন পরীক্ষণমূলক অবস্থায় নির্ভরশীল চলের কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে তা নির্ণয় করা। একটি অনির্ভরশীল চলের সঙ্গে একটি নির্ভরশীল চলের বক্ররৈখিক সম্পর্ক থাকতে পারে যা শুধু বহুদলীয়
নকশার মাধ্যমে পরিমাপ করা যেতে পারে। বহুদলীয় নকশার ফলাফল বিশ্লেষণ করার জন্য ভেদাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়।
৪. উপাদানভিত্তিক নকশা : যখন কোন পরীক্ষণ একই সাথে একাধিক নিরপেক্ষ চলের প্রয়োগ ও তাদের প্রভাব নিয়ে কাজ করা হয় তখন এক বিশেষ ধরনের নকশা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।এই বিশেষ ধরনের নকশাকেই বলা হয় উপাদানভিত্তিক নকশা। উদাহরণস্বরূপ : দুইজন গবেষক Harley এবং Harley (1966) শিক্ষণের উপর সংবেশন (Hypnosis) এর প্রভাব সম্পর্কে একটি গবেষণা করেছিলেন। তাদের সমস্যা ছিল তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া। যথা :
১. সংবেশিত অবস্থা শিক্ষণকে প্রভাবান্বিত করে কি না?
২. সংবেশিত হওয়ার প্রবণতা শিক্ষণকে প্রভাবান্বিত করে কি না?
৩. সংবেশনের মাত্রা এবং সংবেশন প্রবণতা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কি না?
এ তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য তাঁরা একটি উপাদানভিত্তিক নকশা নির্বাচন করেন।
৫. আন্তঃদলীয় নকশা : আন্তঃদলীয় নকশা একটি গবেষণামূলক নকশা। এই ধরনের নকশার পরীক্ষণ পাত্র মূলত একজন বা একদল । দুই বা ততোধিক দলের দ্বারা পরিচালিত পরীক্ষণে পরীক্ষণ দলের উপর স্বাধীন চলের একাধিক মান
বা মাত্রা ব্যবহার করে সাপেক্ষ চলের উপর তাহাদের প্রভাব পরিমাপ করা হয়। কিন্তু আন্তঃদলীয় নকশায় একটি মাত্র দলের উপর স্বাধীন চলের একাধিক মাত্রা বা মান প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ফলে এসব মান অনুযায়ী সাপেক্ষ চলের বা আচরণের উপর প্রভাবগুলো পরিমাপ করা হয়। অতএব এসব আচরণীয় প্রভাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য যাচাই বাছাই ও তুলনা করা হয়।এই পার্থক্যসূচক প্রভাবই হচ্ছে সাপেক্ষ চল যা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করাই পরীক্ষণের মূলকথা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পরীক্ষণমূলক নকশা ব্যবহার করে পরীক্ষণ পরিচালনা করলে ভালো ফলাফল লাভ করার ক্ষেত্রে সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, কোন ধরনের নকশা ব্যবহার করতে হবে কোন ক্ষেত্রে, সেটিই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরীক্ষণের সার্বিক ধরন প্রকৃতির উপরই নির্ভর করে যে কোন ধরনের নকশা ব্যবহার করা যেতে পারে। এটা পরীক্ষণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।