অথবা, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলাফল আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে লর্ড কার্জন কর্তৃক ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে চিহ্নিত। ১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও আসামকে নিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি প্রদেশ গঠন করা হয় এবং ঢাকাকে রাজধানী করা হয়।
অন্যদিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ এবং এর রাজধানী হয় কোলকাতা। এটিই ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলেও বিভিন্ন বিরোধিতার কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। আর পরবর্তীকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া এবং প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক।
পরবর্তী রাজনীতিতে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব : ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর (সূত্র : ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন] বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনা ভারতীয় ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আর পরবর্তী রাজনীতিতে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। নিচে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল বা প্রভাব উপস্থাপন
করা হলো :
১. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া : বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ঘোষণা ছিল তাদের জন্য বিশাল আঘাত। বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলার মুসলমানদের জীবনধারায় যে উন্নতির সূচনা হয়েছিল, তা বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে রুদ্ধ হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজ সরকারের উপর অসন্তুষ্ট হন
এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে তারা তাদের প্রগতির প্রতিবন্ধকস্বরূপ চিহ্নিত করে। এতে মুসলমানরা নিরাশ হয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
২. হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : স্বাভাবিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় হিন্দুরা উল্লসিত হয়। কেননা বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় হিন্দুরা তাদের হারানো প্রভাব প্রতিপত্তি ফিরে পায়। এছাড়া ব্যবসায়ী ও আইনজীবীরা সন্তুষ্ট হন এই ভেবে যে, সমগ্র বাংলা তাদের ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে। মূলত বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় কোলকাতার হিন্দু নেতা, বুদ্ধিজীবী ও
ব্যবসায়ীগণ তাদের হারানো গৌরব ফিরে পায়।
৩. মুসলমানদের আস্থা বিনষ্ট : মুসলমান সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানায়। কেননা বঙ্গভঙ্গ ছিল পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া জনগণের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু হিন্দুদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা করলে মুসলমানদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। মূলত বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাওয়া যায়, যা ব্রিটিশ সরকারের উপর মুসলমানদের আস্থা বিনষ্ট করে।
৪. হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি : বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও তিক্ততা বৃদ্ধি পায়। ফলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়। আর বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা আরো বৃদ্ধি পায়। হিন্দুদেরকে মুসলমানরা তাদের প্রগতির অন্তরায় বলে মনে করতো। অন্যদিকে, হিন্দুরা আন্দোলনের সফলতার
দরুন মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সুযোগ সুবিধার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।
৫. মুসলমানদের কংগ্রেস ত্যাগ : ১৮৮৫ সালে হিন্দু-মুসলিমের যৌথ উদ্যোগে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কংগ্রেস একটি হিন্দু সংগঠনে পরিণত হয়। কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলে অনেক মুসলিম
কংগ্রেসের সদস্য পদত্যাগ করে।
৬. মুসলিম লীগের গতিশীলতা বৃদ্ধি : বঙ্গভঙ্গ রদের পূর্বে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল দুর্বল। এছাড়া এর গতিশীলতাও ছিল কম। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম লীগ সাংগঠনিকভাবে গতিশীল হয়ে উঠে। মুসলমানরা বুঝতে পারে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের আন্দোলনের নিকট নতি স্বীকার করে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। তাই মুসলমানরা কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করে এটিকে আরো গতিশীল করে তোলে।
৭. মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি : বঙ্গভঙ্গ রদের পূর্বে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব ছিল। তাই তারা বঙ্গভঙ্গের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের উপর নির্ভর করে এবং বিশ্বাস করে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে তারা বুঝতে পারে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাই বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ।
৮. হিন্দুদের প্রেরণা ও আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি : বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দুদের প্রেরণা ও আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। হিন্দুরা উপলব্ধি করে আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করায় কংগ্রেস ও তাদের বিজয় সূচিত হয়েছে। ফলে তারা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও দাবিদাওয়া আদায় করতে সচেষ্ট হয়।
৯. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাধা : বঙ্গভঙ্গের পূর্বে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনিত ঘটে। যার ফলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়, যা ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির রাজদরবারে পঞ্চম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ঘটনা ও কারণের প্রেক্ষিতে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণগুলো বিদ্যমান থাকলেও মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রধান কারণ জড়িত ছিল। আর বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক নীতি বিকাশ লাভ করে। যা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরিশেষে বলা যায়, ভারতের পরবর্তী রাজনীতিতে বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব বা ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।