ভূমিকা : ভারতবর্ষের জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে এবং তাদেরকে অপেক্ষাকৃত উত্তমরূপে শাসন করবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন পাস করেছে । এ সমস্তআইন ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসের অগ্রগতিকে বহুদূরে এগিয়ে নিয়ে যায় । ১৮৬১ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এবং সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য স্তম্ভবা ফলক । কারণ এই আইনের মধ্যে দিয়েই প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার জন্ম হয় । যদিও এ ব্যবস্থা ছিল পরোক্ষ পদ্ধতির । অচিরেই এই আইনের ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে । এরপর ১৮৯২ সালে | কাউন্সিল আইন পাস হয় । তবে ১৯০৯ সালের মর্নি – মিন্টো সংস্কারের ফলে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো নির্বাচনের নীতি প্রবর্তন করা হয় । ১৯০৯ সালের আইন অনুসারে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোতে | নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয় । তবে এই সব আইন পরিষদগুলো গভর্নর ও গভর্নর | জেনারেলের উপদেষ্টা কমিটি হিসাবেই কাজ করত । এদের আইন প্রণয়নের প্রকৃত কোন ক্ষমতা ছিল না । পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন পাস করে ভারতবর্ষে পর্যায়ক্রমে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে । কিন্তু ভারতের সব রাজনৈতিক দলই একে অসম্পূর্ণ , অসন্তোষজনক ও নৈরাজ্যকর বলে ঘোষণা করে । ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ঘোষণা করেন । ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে । বস্তুত ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ , রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার ফলশ্রুতি হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন । বলা b যায় এ আইন পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মূলভিত্তি রচনা করে । অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের । স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র । সুতরাং এদিক থেকে বিবেচনা করলে ১৯১৯ সালের ভারত | শাসন আইন এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে । ভারত শাসন আইন ও রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ ( ১৯১৯-১৯৩৭ ) ‘ শীর্ষক ইউনিটের বিষয়কে আমরা দুটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করব ।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : প্রাদেশিক সায়ত্তশাসন বলতে বোঝায় কোন রাষ্ট্রের প্রদেশের নিজস্ব আইন , সংবিধান ও নিয়ম এর অপর চলার ক্ষমতা । এ পদ্ধতিতে প্রতিরক্ষা , পররাষ্ট্র ব্যতীত প্রায় সকল ক্ষেত্রে প্রদেশসমূহ নিজেরাই | নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে । বিনিময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট বাৎসরিক অর্থ প্রদান করা হয় । ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন । স্বায়ত্তশাসন বলতে বুঝায় স্বায়ত্তশাসন । শব্দগত অর্থে তাই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে বুঝায় প্রদেশের নিজস্ব শাসন । কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে , প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কথাটির অর্থ | আরও ব্যাপক । সংবিধানের আওতায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে প্রাদেশিক সরকার পরিচালনার ক্ষমতাকেই তারা প্রাদশিক স্বায়ত্তশাসন বলে অভিহিত করেছেন । প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের | ধারণা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত । যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় সরকারের সব | ক্ষমতা সংবিধানের মাধ্যমে সংবিধানিক নিয়মানুযায়ী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার একে অপরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত ও স্বাধীন থেকে নিজ নিজ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে । এটিই যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । সাধারণত প্রতিরক্ষা , বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থ এ তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে ।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তিনটি নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যেমন :
১। আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলো কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকবে এবং সেই সাথে প্রাদেশিক আইন সভা প্রাদেশিক সরকারেরও নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে । অর্থাৎ সংবিধানে প্রদেশের জন্য যে বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক | সরকারের উপর কোনরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না ।
২। প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে । অর্থাৎ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হবে । প্রাদেশিক | আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য আইন সভার কাছে দায়ী থাকবে ।
৩। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে । জাতীয় সম্পদ ও রাজস্ব বন্টনের ক্ষেত্রে এমন নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে যেন কোন প্রদেশকে আর্থিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হতে না হয় । ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রকৃতি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা করা হয় । প্রস্তাবিত এ যুক্তরাষ্ট্রে | প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হয় । প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই আইনে শাসন সংক্রান্ত|
বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় , প্রাদেশিক ও যুগ্মতালিকায় ভাগ করা হয় । প্রাদেশিক বিষয়গুলোর পরিচালনার | ভার প্রাদেশিক সরকারের উপর অর্পিত হয় । একই সঙ্গে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদেশে যে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করা হয়েছিল তা বাতিল করে দেওয়া হয় । গভর্নর ও মন্ত্রিসভা গঠিত হয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদেরকে নিয়ে । প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে | আইনসভার নিকট দায়ী করা হয় । এভাবেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে তত্ত্বগতভাবে প্রাদেশিক | স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । |
সারকথা : ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন । এ আইনের মাধ্যমে প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের কথা ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করলেও এই ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ কাজ । ফলে ১৯৩৫ সালের আইন বাস্তব প্রয়োগে ব্রিটিশ সরকার ব্যর্থ হয় । অবশ্য একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর রাজনৈতিক দাবি , জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং | ক্রমবর্ধমান অধিকার ও সচেতনতার চাপে বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য | ক্রমাগতই উন্নততর ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে । ১৮৬১ , ১৮৯২ , ১৯০৯ , ১৯১৯ সলের ভারত আইন অপেক্ষা ১৯৩৫ সালের আইনের প্রকৃতি , বৈশিষ্ট্যই এর উদাহরণ । তথাপি এর ত্রুটি , অবাস্তব কাঠামো , ক্ষমতা বণ্টন প্রভৃতি নীতিগুলোর কারণে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় ।