অথবা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। এটি ছিল আইয়ুব বিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চা বা প্লাটফর্ম ছিল। এর লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানের জন্য একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র লাভ। এর তেমন কোন সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। বস্তুত NDF বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ছিল একটি আন্দোলন।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টেন গঠন : NDF এর গঠন ছিল সময়ের দাবি। আইয়ুবের দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে রাজনৈতিক দলের তৎপরতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রপতি একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করলেও, সামরিক শাসন প্রত্যাহার হয় আরো পরে ৮ জুন। অবশেষে সামরিক শাসন প্রত্যাহার হয় বটে তবে রাজনৈতিক দলের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তখনো অব্যাহত থাকে। ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষ রাজনৈতিক দল গঠন বা পুনরুজ্জীবিত না করে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের একদফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হয়। প্রবীণ নেতা সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এর প্রধান প্রবক্তা। আইয়ুবি শাসনতন্ত্র জারির পর ১৯৬২ সালের ২৪ জুন ‘নয় নেতার বিবৃতি’কে এ ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠনের প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আইয়ুব সরকার বিরোধী সদস্যদের দ্বারা ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠিত হয়। আহ্বায়ক করে।
‘ন্যাশনাল ডিভোকেট আব্দন আহমদকে আফসার উদ্দিন আ এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯ আগস্ট মুক্তিলাভ করে তিনি ‘নয় নেতার বিবৃতি’র প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরপর একই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর তার নেতৃত্ব পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নিজাম-ই-ইসলামী এবং মুসলিম লীগের আইয়ুব বিরোধী অংশ নিয়ে রাজনৈতিক মোর্চা, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৬২ হয়তো উদ্দেশ্য ছিল, এর অধীনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন ঘটবে এবং তখন সরকার বিরোধী ঐক্যবদ্ধ NDF এর কার্যক্রম ও সরকারের পদক্ষেপ : আইয়ুব সরকার কর্তৃক ‘রাজনৈতিক দল বিধি’ পাসের ১৫ জুলাই আন্দোলনের পরিবর্তে তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব সে সম্ভাবনাকে বেশ কিছু সময়ের জন্য হলেও নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের উভয় অংশের বিভিন্ন
শহরে তাঁর নেতৃত্বে একের পর এক জনসভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এসব জনসভায় লাখো জনতার সমাবেশ ঘটে। দেজুড়ে সৃষ্টি হয় গণজোয়ার। এর বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকার নানা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে :
১. সোহরাওয়ার্দীর জনসভা স্থলে ১৪৪ ধারা জারি;
২. সরকারি সন্ত্রাসী দ্বারা জনসভা ভেঙে দেয়;
৩. জীবননাশের হুমকি।
পূর্বের এবডোভুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক দল বা দলের তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। তাই NDF এর ছত্রছায়ায় এরা রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকল। ১৯৬৩ সালের ৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনেন। এরপর থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য গঠিত কিংবা রাজনৈতিক প্রচার কার্যে নিয়োজিত ফ্রন্ট বা মোর্চা এর আওতাভুক্ত হবে। এবডোভুক্তদের কেউ কোন ফ্রন্টের সঙ্গে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করলে তার বিরুদ্ধে দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা কিংবা উভয় ধরনের শাস্তির বিধান করা হয়।
NDF এর স্তিমিত অবস্থা : নানা প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এনডিএফ তৎপরতা চালিয়ে য
েতে থাকে। কিন্তু ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে সোহরাওয়ার্দী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে এর কর্মকাণ্ডে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। চিকিৎসার উদ্দেশ্য তাঁর বিদেশ গমন এবং ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের
এক হোটেলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। NDF এর জন্য এটা ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর NDF এর হাল ধরার জন্য তাঁর মতো আর কোন নেতা থাকে না। আওয়ামী লীগসহ NDF ভুক্ত অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে পার্টি পুনরুজ্জীবনের চিন্তাভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়। কোন কোন দল এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে একটি কার্যকর রাজনৈতিক মোর্চা হিসেবে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মৃত্যু ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, লৌহ মানবের শত বাধা অতিক্রম করে একদল সাহসী প্রাণ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন করে। কিন্তু আইয়ুব সরকার বিভিন্নভাবে বাধা প্রতিরোধ করতে থাকে। ফলে এ রাজনৈতিক মোর্চা বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, মওলানা ভাসানীর রণে ভঙ্গ NDF রাজনৈতিক মোর্চা স্তিমিত হয়ে যায়।