অথবা,ন্যায়দর্শন অনুসারে জীবাত্মার স্বরূপ সংক্ষেপে আলোচনা কর ।
অথবা, ন্যায়দর্শনে জীবাত্মার প্রকৃতি কীরূপ?
অথবা, নৈয়ায়িকদের মতে জীবাত্মার প্রকৃতি লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ন্যায়দর্শন আস্তিক বস্তুবাদী দর্শন। মহর্ষি গৌতম ন্যায়দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। ন্যায়দর্শনের আলোচ্যবিষয়কে চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক. জ্ঞানতত্ত্ব; খ. জগত্তত্ত্ব; গ. জীবাত্মার স্বরূপ ও মুক্তিতত্ত্ব এবং ঘ.
ঈশ্বরতত্ত্ব। ন্যায়দর্শনে দুই প্রকারের আত্মাকে স্বীকার করা হয়। যথা : ১. জীবাত্মা এবং ২. পরমাত্মা। ন্যায় মতে, আত্মা একটি অজৈবিক দ্রব্য । এটি নিত্য ও সর্বব্যাপী। দেশ ও কাল আত্মাকে সীমিত করতে পারে না। নৈয়ায়িকদের মতে, এক একটি দেহে এক একটি আত্মা বিদ্যমান এবং চৈতন্য আত্মার একটি আগন্তুক গুণ। নিম্নে জীবাত্মার স্বরূপ আলোচনা করা হলো :
আত্মা দেহ নয় : ন্যায়দর্শন অনুসারে আত্মা সম্পর্কে চার্বাকদের মতবাদ সত্য হতে পারে না। কারণ আত্মা দেহ নয়। দেহ জড়পদার্থ বলে চৈতন্যহীন; কিন্তু আত্মা চৈতন্যময়। দেহ পরিবর্তনশীল এবং জন্ম-মৃত্যুর অধীন। কিন্তু আত্মা অপরিবর্তনীয় ও নিত্য। আত্মার জন্মও নেই, মৃত্যু নেই ।
আত্মা ইন্দ্রিয় নয় : ন্যায় মতে, আত্মা ইন্দ্রিয় নয়। কারণ কল্পনা, স্মৃতি, চিন্তা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলো ইন্দ্ৰিয় নির্ভর নয়। ইন্দ্রিয় নষ্ট হলেও চিন্তা, কল্পনা প্রভৃতি চলতে পারে। আত্মাকে যদি ইন্দ্রিয় মনে করা হয় তবে কল্পনা, স্মৃতি, চিন্তা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
আত্মা মন নয় : ন্যায় মতে আত্মা মন হতে পারে না। আত্মা যদি মন হয় তবে সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা প্রভৃতি আত্মার গুণগুলোকেও মনের গুণ বলতে হয়। ন্যায় মতে, মন অপুপরিমাণ, তাই প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। কাজেই সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মনের গুণ বলে মনের ন্যায় এরাও প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। কিন্তু আসলে সব মানুষই সুখ, দুঃখ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করে থাকে।
আত্মা পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার প্রবাহ নয় : ন্যায় মতে আত্মা পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহ নয়। আত্মাকে যদি পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহ বলে মনে করা হয় তবে স্মৃতি এবং প্রত্যভিজ্ঞাকে (Recognition) ব্যাখ্যা করা যায় না। কারণ পরিবর্তনশীল মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহের যে কোন একটি তার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কোন প্রক্রিয়াকে জানতে পারে না। তাই স্মৃতি বা প্রত্যভিজ্ঞা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকল মানুষই অল্প বিস্তর স্মরণ করতে পারে এবং করে থাকে। কাজেই অপরিবর্তিত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হয় এবং এ আত্মা আছে বলেই স্মৃতি এবং প্রত্যভিজ্ঞা সম্ভব হয় ।
আত্মা বিশুদ্ধ চৈতন্য নয় : ন্যায় মতে আত্মা সম্পর্কে অদ্বৈত বৈদান্তিকদের মতবাদও গ্রহণ করা যায় না। তাদের মতে আত্মা বিশুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ। কিন্তু ন্যায় মতে, কোন আধারকে আশ্রয় না করে চৈতন্যের অস্তিত্বও সম্ভব নয়। কাজেই চৈতন্যের আধারস্বরূপ আত্মাকে স্বীকার করতে হবে।
আত্মা চৈতন্য বিশিষ্ট দ্রব্য : ন্যায়দর্শন অনুসারে আত্মা একটি চৈতন্য বিশিষ্ট দ্রব্য। আত্মা হলো কর্তা, জ্ঞাতা, ভোক্তা এবং অহংকারের আশ্রয় বা অহংপদবাচ্য। দেহ, ইন্দ্রিয়, মন-এসবই আত্মার করণ (Instrument)।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ন্যায় মতে, জীবাত্মা একটা দ্রব্য যা স্বরূপত অচেতন এবং নির্গুণ। দেহের সাথে সংযোগের ফলেই আত্মায় চেতনার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষের সাহায্যেই আমরা জানতে পারি যে, আত্মা এক চৈতন্যময় সত্তা। চৈতন্য আত্মার গুণ নয়, আত্মার সারধর্ম।