ন্যায়দর্শনে লৌকিক প্রত্যক্ষ সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, ন্যায় মতে লৌকিক প্রত্যক্ষ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ন্যায় মতে লৌকিক প্রত্যক্ষ কী?
অথবা, ন্যায়দর্শনে লৌকিক প্রত্যক্ষ বলতে কি বুঝানো হয়েছে?
অথবা, নৈয়ায়িকদের লৌকিক প্রত্যক্ষ সংক্ষেপে লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনের আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। নৈয়ায়িকদের মতে, প্রমাণ (Valid knowledge) চার প্রকার। যথা : ১. প্রত্যক্ষ; ২. অনুমান; ৩. উপমান ও ৪. শব্দ। মহর্ষি গৌতমের মতে, প্রত্যক্ষ হলো বিষয় এবং ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত বিষয়ের নিশ্চিত এবং যথার্থ জ্ঞান। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষ থেকেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উদ্ভব। ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষকে আত্মার কার্য বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষে প্রথম আত্মার সাথে মনের সংযোগ ঘটে। ন্যায়দর্শনের প্রত্যক্ষকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ১. লৌকিক প্রত্যক্ষ (Ordinary perception) এবং ২. অলৌকিক প্রত্যক্ষ (Extra Ordinary Perception)।
লৌকিক প্রত্যক্ষ (Ordinary perception) :
সংযোগের ফলে যে প্রত্যক্ষ হয় তাই লৌকিক প্রত্যক্ষ। আমাদের ইন্দ্রিয় দুই প্রকার বলে লৌকিক প্রত্যক্ষ দুই প্রকার। যথা :
চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয় বা বস্তুর
ক. বাহ্য লৌকিক প্রত্যক্ষ এবং খ. আন্তর বা মানস লৌকিক প্রত্যক্ষ।
ক. বাহ্য লৌকিক প্রত্যক্ষ : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক-এ পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে যে সকল প্রত্যক্ষ হয় তাদেরকে বাহ্য লৌকিক প্রত্যক্ষ বলে। যেমন- চক্ষু দ্বারা একটি ফুল দেখা, কর্ণ দ্বারা একটি গান শোনা ইত্যাদি। বাহ্য লৌকিক প্রত্যক্ষ পাঁচ প্রকার। যথা :
১. চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ; ২. শ্ৰোত প্রত্যক্ষ; ৩. ঘ্রাণজ প্রত্যক্ষ; ৪. রাসন প্রত্যক্ষ এবং ৫. স্পর্শন প্রত্যক্ষ।
খ. আত্তর বা মানস লৌকিক প্রত্যক্ষ : মন বা অন্তর ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা ইত্যাদি মানসিক প্রক্রিয়ার সংযোগের ফলে যে প্রত্যক্ষ হয় তাকে আন্তর প্রত্যক্ষ বলে। যেমন- দুঃখরূপ মানসিক প্রক্রিয়াকে প্রত্যক্ষ করা।
অপর একটি নীতি অনুসারে লৌকিক প্রত্যক্ষকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা :
খ. সর্বিকল্প প্রত্যক্ষ এবং
ক. নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ;
গ. প্রত্যভিজ্ঞা।
ক. নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ : যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কোন বস্তুকে কেবল বস্তু বলেই জানা হয় অর্থাৎ বস্তুর কেবল অস্তিত্বকেই জানা হয় কিন্তু অন্য কোন গুণ জানা হয় না তাকে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলে। যেমন- এটি শুধুমাত্র একটি ফুল । নির্বিকল্প হলো প্রাথমিক চেতনা।
খ. সর্বিকল্প প্রত্যক্ষ : যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কোন বস্তুকে কেবল বস্তু বলেই জানা হয় না বরং তার সম্পূর্ণ বিবরণ জানা হয় অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব তার জাতি ও বিভিন্ন গুণ সম্পর্কে জ্ঞান হয় তাকে সর্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলে। যেমন- গোলাপ ফুলটি লাল ।
গ. প্রত্যভিজ্ঞা : পূর্বজ্ঞাত কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে পূর্বজ্ঞাত বলে চিনতে পারাই প্রত্যভিজ্ঞা। যেমন- কোন ব্যক্তিকে দেখে যখন বলা হয়, এ সেই ব্যক্তি যাকে গতকাল ঢাকা কলেজে দেখেছিলাম তখন এ অভিজ্ঞতাকে প্রত্যভিজ্ঞা (Recognition) বলে ।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ন্যায়দর্শনের প্রত্যক্ষজ্ঞান দ্বিবিধ; সর্বিকল্প ও নির্বিকল্প। প্রত্যক্ষের এ দুটি ধারণার সাথে পাশ্চাত্য দার্শনিক লক ও হিউমের প্রত্যক্ষতত্ত্বের তুলনা করা যেতে পারে। এ কথা সত্য যে, যথার্থ জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষের ভূমিকা অপরিসীম।