নৈতিক শিক্ষায় বুদ্ধদেবের দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা কর।

অথবা, গৌতম বুদ্ধের নৈতিক উপদেশাবলির অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্বসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গৌতম বুদ্ধের নৈতিক উপদেশাবলির ভিতর দিয়ে কোন দার্শনিক তত্ত্ব ব্যক্ত করেন? আলোচনা কর ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গৌতম বুদ্ধের বাণী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠে সে মতবাদকে ‘বৌদ্ধ দর্শন’ বা ‘বৌদ্ধধর্ম’ বলে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরে এক রাজ পরিবারে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। তাঁর পূর্ব নাম ছিল গৌতম বা সিদ্ধার্থ। তিনি নিজ আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষ তলে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতের দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। বুদ্ধদেবের নৈতিক উপদেশাবলির অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্ব : বুদ্ধদেব দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায়
তেমন বেশি আগ্রহী ছিলেন না। নৈতিক উপদেশই ছিল তাঁর শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। তবু তাঁর নৈতিক শিক্ষার মূলে কতকগুলো দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে অভিমত পাওয়া যায়। এ মতবাদ প্রধানত চারটি। যথা :
১. প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ : বুদ্ধদেবের মতে, এ জগতে কোন বস্তু বা ঘটনা আত্মনির্ভর নয় এবং কারণ বিনা কিছুই ঘটে নি। জাগতিক সকল বস্তুই এক সর্বব্যাপক ও অবশ্য স্বীকার্য ‘কার্যকারণ’ নিয়মের অধীন। বৌদ্ধ মতে, এ কার্যকারণ নিয়ম জগতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে চলছে। ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় চেতনা সত্তার দ্বারা এ নিয়ম
পরিচালিত হয় না। এ কার্যকারণ নিয়মকে বৌদ্ধ দর্শনে ‘প্রতীত্য সমুৎপাদ’ বলা হয়। যার সহজ অর্থ হলো যে কোন বস্তু বা ঘটনা পূর্ববর্তী বস্তু বা ঘটনা হতে সমুৎপন্ন। বুদ্ধদেব এ মতবাদটির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং একে ধর্ম নামে অভিহিত করেছেন। বুদ্ধদেবের মতে, কেউ যদি তাঁর উপদেশের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে চান, তবে প্রথমেই তাকে প্রতীত্য সমুৎপাদ নিয়মকে বুঝতে হবে। বুদ্ধদেবের চারটি আর্যসত্যও এ মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ মতবাদের সাহায্যেই বুদ্ধদেব জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন এবং দুঃখের উৎপত্তির কারণ ও নিবৃত্তির পথের নির্দেশ দিয়েছেন। তাছাড়া বুদ্ধদেবের অন্যান্য দার্শনিক মতবাদগুলোও প্রতীত্য সমুৎপাদ নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত।
২. কর্মবাদ : কর্মবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদের একটি বিশেষ প্রকাশ মাত্র। কর্মবাদ অনুসারে মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। কর্মবাদ অনুযায়ী মানুষের বর্তমান অবস্থা তার পূর্ববর্তী কর্মেরই পরিণতি এবং বর্তমান কর্মের পরিণতি হবে ভবিষ্যতের অবস্থা। প্রতীত্য সমুৎপাদ নিয়ম অনুসারে প্রতিটি বস্তু বা ঘটনার কারণ
আছে। সুতরাং মানুষের বর্তমান জীবনেরও একটি কারণ আছে। বুদ্ধদেবের মতে, সে কারণটি হলো মানুষের পূর্ববর্তী জীবনের কর্ম। বুদ্ধদেবের মতে, কর্ম দুই প্রকারের। যথা : সকাম কর্ম এবং নিষ্কাম কর্ম। বাসনাজাত এবং মোহযুক্ত কর্ম হলো সকাম কর্ম, আর বাসনাহীন এবং মোহযুক্ত কর্ম হলো নিষ্কাম কর্ম। মানুষ নির্বাণ লাভের পর যে কর্মসম্পাদন করে তাকে বলা হয় নিষ্কাম কর্ম। বুদ্ধদেব বলেছেন, আগুনে ভাজা বীজ রোপণ করলে যেমন কোন ফলোৎপাদন হয় না, তেমনি নিষ্কাম কর্মও ফলপ্রসূ হয় না। বুদ্ধদেব আরো বলেছেন, মানুষ ইচ্ছা করলে তার পূর্ব কর্মের রূপের পরিবর্তন করে বর্তমান অবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারে।
৩. সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যতাবাদ বা ক্ষণিকত্ববাদ : সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যতাবাদ প্রতীত্য · সমুৎপাদ হতেই উদ্ভূত হয়েছে। প্রতীত্য সমুৎপাদ অনুযায়ী সকল বস্তু বা ঘটনার কারণ আছে। সুতরাং কারণটির পরিবর্তন হলে কার্যের আবির্ভাব হয় এবং কারণটি ধ্বংস হলে কার্যটিরও ধ্বংস হয়। বুদ্ধদেব বলেছেন, সবকিছুই পরিবর্তনশীল,
সবকিছুই ধ্বংসশীল এবং সবকিছুই অনিত্য। যার আদি আছে তার অন্তও আছে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে। আপাতদৃষ্টিতে কোন বস্তুকে চিরস্থায়ী মনে হলেও আসলে তা চিরস্থায়ী নয়। এ অনিত্যতাবাদকে বুঝানোর জন্য বুদ্ধদেব দুটি উপমার ব্যবহার করেছেন। একটি অগ্নিশিখা এবং অপরটি নদীর জলধারা। অগ্নিশিখা যেমন নিয়ত চঞ্চল, নদীর জলধারাও তেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল। তেমনি জগতের সকল কিছুই অগ্নিশিখার মতো চঞ্চল এবং নদীর জলধারার মতো পরিবর্তনশীল। বুদ্ধদেবের অনুগামীরা বুদ্ধদেবের এ অনিত্যতাবাদকে ক্ষণিকত্ববাদে পরিণত করেছেন। ক্ষণিকত্ববাদ অনুসারে জগতের সবকিছু কেবল অনিত্য নয়, একেবারে ক্ষণস্থায়ী।
৪. অনাত্মবাদ : বুদ্ধদেব মানুষের মধ্যে শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, জগতের সবকিছুই যখন অনিত্য তখন চিরন্তণ আত্মার অস্তিত্ব থাকাও সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, মানুষের আত্মা নিত্য ও চিরন্তন। দেহের বিনাশ আছে, কিন্তু আত্মার বিনাশ নেই। কিন্তু বুদ্ধদেব আত্মার নিত্যতাকে অস্বীকার করেন। বুদ্ধদেবের মতে, মানুষের মধ্যে সুখদুঃখ প্রভৃতি নানারকমের অনুভূতি, চিন্তা ও ইচ্ছা অহরহ আসা যাওয়া করছে। এসব মানসিক প্রক্রিয়ার ধারা বা প্রবাহই আত্মা। বুদ্ধদেবের মতে, এ মানসিক প্রক্রিয়াগুলো ক্ষণস্থায়ী এবং এদের অন্তরালে কোন চিরন্তন সত্তা নেই। কিন্তু প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে বুদ্ধদেব আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন নি, বরং তিনি নিত্য শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, নৈতিক শিক্ষায় বুদ্ধদেবের দার্শনিক তত্ত্বসমূহের আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গৌতম বুদ্ধ যে পরিবর্তনশীল দর্শনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন তারই প্রতিধ্বনি গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের দর্শনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। গৌতম বুদ্ধের দার্শনিক তত্ত্ব তৎকালীন ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অচিরেই বৌদ্ধধর্ম সিংহলো, শ্যাম, ব্রহ্মদেশ, তিব্বত, কোরিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে
এবং বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধ দর্শন আজও পৃথিবীর বুকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।