নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের ঐতিহাসিক পটভূমি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম বলতে কী বুঝায়? নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য যে ধারণা দেন তা আধুনিকায়ন তত্ত্ব। আধুনিকায়ন তত্ত্বের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলো এগিয়ে যেতে না পারায় আধুনিকায়ন তত্ত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনা লেখা শুরু হয়। এ সমালোচনামূলক লেখা থেকে আরেকটি নতুন তাত্ত্বিক মতবাদগোষ্ঠী বিকাশ লাভ করে যা নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম নামে খ্যাত ।
ক. নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের প্রেক্ষাপট (Background of modernization paradigm) : ষাটের দশকের আগে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব ব্যাপকতা লাভ করতে পারে নি। ষাটের দশকে আধুনিকায়ন তত্ত্ব ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এ সময় সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে আধুনিকায়নের তাত্ত্বিকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা লেখা শুরু হয়। এ সময় কতিপয় সমালোচক মনোভাবাপন্ন সমাজবিজ্ঞানীর আবির্ভাব হয়। এ সকল তাত্ত্বিকগণের মধ্যে পল ব্যারন, স্টিভেন হেগেন, আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক এবং কার্ডোসা ও ফ্যালিটো-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এসব তাত্ত্বিকদের সমালোচনামূলক লেখা থেকে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম-এর বিকাশ সাধিত হয়। নিম্নে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
রাউল প্রবিশ এর প্রতিবেদন (Report of Raul Probish) : ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের উদ্যোগে ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নয়নের কারণ অনুসন্ধানের জন্য ‘ECLA’ (Economic Commission of Latin America) নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। রাউল প্রবিশ ছিলেন এ কমিশনের প্রধান। রাউল প্রবিশ বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে
সঠিক ধারণা নয়। কারণ দেখান যে, উন্নত দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলো যে উন্নতি লাভ করবে তাঁর বিশ্লেষণে তিনি স্পষ্ট তুলে ধরেন যে, অনুন্নত দেশগুলো সাধারণত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে এবং আমদানি করে শিল্পজাত পণ্য। এছাড়া বাণিজ্যের শর্ত ক্রমাগত অনুন্নত দেশগুলোর প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি এ ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনুন্নত দেশগুলোকে আমদানি বিকল্প শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হতে সুপারিশ করেন। এছাড়া তিনি যুক্তি দেখান, যখন থেকে ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে তখন থেকেই এখানকার অনুন্নয়ন শুরু হয়ে গেছে। এর কারণ ঔপনিবেশিক শক্তি তাঁর দেশে উপনিবেশভুক্ত দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের মূল উৎপত্তিস্থল হলো ‘রাউল প্রবিশের’ রিপোর্ট। রাউল প্রবিশ তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমকে যে স্বতঃসিদ্ধকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে তা হলো, “একটি সমাজের উন্নয়ন অন্য একটি সমাজের অনুন্নয়নের কারণ।” অর্থাৎ বলা যায়, পুঁজিবাদী দেশগুলোর উন্নয়ন এবং বাকি দেশগুলোর অনুন্নয়ন প্রক্রিয়া দুটি বিপরীত ফলাফল । এছাড়া আজ আমরা যাকে উন্নত বিশ্ব বলে মনে করি তা তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করেই উন্নত হয়েছে।

ম্যাটস মাস-এর নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম (Dependency paradigm of Matts Mass) : ম্যাটস মাস তাঁর বিবরণে বলেন, একটি সমাজের মধ্যেও নির্ভরশীলতা থাকতে পারে। সাধারণত একটি সমাজের ভিতরে প্রভাব বিস্তারকারী উপদল থাকে যা সমাজের বিভিন্ন কাঠামো ও অর্থনীতির মধ্যে অসমতার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন- ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী যারা শহরে বাস করে এবং এককভাবে ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে, সংখ্যাগুরু একটি গোষ্ঠী যারা উৎপত্তিগতভাবে কৃষক এবং গ্রামে বাস করে। শহরের অভিজাত শ্রেণী গ্রামের কৃষক শ্রেণীকে শোষণ করে এবং শোষণের ফলে দেখা যায় গ্রামীণ এলাকা অপেক্ষা শহর এলাকা অনেক উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। ফলে গ্রাম ও শহর এলাকার মধ্যে একটা নির্ভরশীলতা তৈরি হয়।
গ্রিফিনের নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম (Dependency paradigm of Griffin) : গ্রিফিন তাঁর বিবরণে বলেন, আমরা যদি অনুন্নত দেশগুলোকে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব এসব অনুন্নত দেশগুলো সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপের বিস্তারের কারণে। তিনি বলেন, ইউরোপ অনুন্নত বিশ্বকে আবিষ্কার করে নি, বরং ইউরোপ নিজেই অনুন্নত দেশগুলোকে সৃষ্টি করেছে। এদিক থেকে দেখা যায়, অনুন্নত দেশগুলো তাদের বাহ্যিক কেন্দ্রীয় শক্তির সাহায্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষিত হয়ে আসছে এবং তাদের স্যাটেলাইট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তাই অনুন্নত দেশগুলো পিছনে পড়ে যাচ্ছে। আন্দে শুভার ফ্রাংক-এর নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম (Dependency paradigm of A. G. Frank) :
নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক চিলির সমাজের বিবরণ দেন। চিলির সমাজ সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি একটি বইয়ের মধ্যে অনন্ত্রে উন্নয়ন সম্পর্কে বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাদ ব্যবস্থার মাধ্যমে কেন্দ্রের রাষ্ট্রসমূহ সমগ্র বিশ্বকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলে । এ ভাগ দুটি হলো :
ক. স্যাটেলাইট রাষ্ট্র (Satellite state) : আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংক তাঁর গবেষণায় দেখান যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেট্রোপলিটন রাষ্ট্র স্যাটেলাইট রাষ্ট্রকে শোষণ করে এবং স্যাটেলাইট রাষ্ট্রকে প্রাপ্য বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে স্যাটেলাইট রাষ্ট্র যে দুর্বল ও অনুন্নত থাকবে তা স্বীকার করতে হয়।
খ. মেট্রোপলিটন রাষ্ট্র (Metropolitan state) : মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্যারাডাইম তাত্ত্বিকরা অভিমত দেন যে, মেট্রোপলিটন রাষ্ট্র তাদের উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমে ইচ্ছা করলেই অনুন্নত সমাজকে উন্নত করতে পারে। কিন্তু তারা এসব সমাজের উৎপাদন পদ্ধতি নিজেদের উৎপাদন পদ্ধতির অংশ মনে করে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখলের জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখেন। ফলে তৃতীয় বিশ্বের সমগ্র বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। যার জন্য এসব সমাজের উৎপাদন পদ্ধতিতে কোন পরিবর্তন হয় নি। পল ব্যারন এর নির্ভরশীলতা প্যারাডাইন (Dependency paradigm of Paul Baron) : পল ব্যারন নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, উন্নত জাতিসমূহ মূলত অনুন্নত দেশসমূহের শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করেছে। যার জন্য এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিল্পকারখানা গড়ে উঠে নি। এ সুযোগ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলো বিশ্বশিল্পের কাঁচামালের উৎস হিসেবে একে বেছে নেয় এবং তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান, দক্ষতা এবং ভারী যন্ত্রপাতি রপ্তানির মাধ্যমে বিশ্ব বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের উৎপত্তি আধুনিকায়ন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হলেও তা তেমন অনুন্নত দেশের অবস্থার উন্নয়নে সফল হয় নি বরং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর আরো অনেক রকম বুঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের অবস্থার পুরোপুরি সফল না হলেও নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম সমকালীন সমাজ বিকাশে অনেকটা সহা য়ক হয়েছিল। তাই সার্বিক বিচারে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ছিল তা বলা যায় ।