নয়নচারা’ গল্পটি ছিন্নমূল অসহায় আমুর জীবনচিত্র।- এ উক্তির আলোকে ‘আমু’ চরিত্র বিশ্লেষণ কর।

অথবা, “আমু দুর্ভিক্ষতাড়িত ছিন্নমূল মানুষের প্রতিনিধি”— এ উক্তির প্রেক্ষিতে ‘নয়নচারা’ গল্প অবলম্বনে আমুর চরিত্র আলোচনা কর।
অথবা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ‘নয়নচারা’ গল্প অবলম্বনে আমুর চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আমু কে? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ‘নয়নচারা’ গল্পের আমু চরিত্র বিশ্লেষণ কর।
অথবা, আমু চরিত্রের যেসব বৈশিষ্ট্য পাঠকের সহানুভূতিতে সিক্ত হয়ে উঠেছে তা তোমার নিজের ভাষায় বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মনস্তত্ত্বের জটিল জিজ্ঞাসার অভিমুখী জীবনবাদী কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবনকে দেখেছেন খুব কাছাকাছি থেকে, ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাস-নাটকে মানুষের জীবনযন্ত্রণার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘নয়নচারা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিরচিত একটি জীবনমুখী সামাজিক ছোটগল্প। এ গল্পের কাহিনি বলতে তেমন কিছু নেই। দুর্ভিক্ষতাড়িত একদল মানুষের দুঃখকষ্টের কথা আমু নামক মানুষটির মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। নিচে আমুর চরিত্রচিত্রের কিছু পরিচিতি তুলে ধরা হলো:
আমুর পরিচয় : আমুর জন্ম ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে নয়নচারা গ্রামে। নয়নচারা বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতোই শোভা-সৌন্দর্যে অপরূপ। এখানে যারা বসবাস করে তারা সকলেই প্রকৃতির মতো সহজসরল। দুর্ভিক্ষের কারণে আমু গ্রামের মানুষদের সাথে শহরে চলে আসে। তারা সকলে মিলে শহরের রাস্তার ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়। দিনের বেলা আমু রাস্তায়-রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে-বাড়িতে মানুষের দরজায় দরজায় ভিক্ষা করে আর রাতের বেলায় ফুটপাতে শুয়ে নয়নচারা গ্রামের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাসে বুক কাঁপায়।
সহজসরল আমু : আমু প্রকৃতির সন্তান। সে সহজসরল সাধারণ মানুষ। তার মধ্যে জটিলতা বলতে কিছু নেই। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে আমু শহরের মানুষদের নিজের মতোই সহজসরল মনে করেছিল। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তার ভুল ভেঙে যায়। আমু বুঝতে পারে এ শহরে যারা বাস করে তারা ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ। নয়নচারা গ্রামের মানুষদের সাথে এদের তফাৎ অনেক। সরল স্বভাবের আমুর কাছে শহরের মানুষের এ রূপটি ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।
স্নেহের কাঙ্গাল আমু : ইট-পাথরে নির্মিত শহর। এখানকার মানুষগুলোকেও আমুর কাছে মনে হয়েছে পাষাণ হৃদয়। তবুও এদের মধ্যে লালপেড়ে শাড়িপরা মেয়েটির পয়সা দান আমুকে বিস্মিত করে। মেয়েটির মাথার চুল অবিকল তাদের গাঁয়ের ঝিরা নাম্নী মেয়েটির মাথার চুলের মতোই। শহরের রুক্ষমেজাজি মানুষের মধ্যে মেয়েটি কত ব্যতিক্রম। এখানে মনের কথা খুলে বলার লোক নেই। তাদের গাঁয়ের মানুষগুলোও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে শহরে এসে বদলে গেছে। তাই দারুণভাবে স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে পড়েছে আমু।
কল্পনাপ্রবণ আমু : গ্রামছাড়া উদ্বাস্তু আমুর মধ্যে একটা কল্পনাপ্রবণ মানুষ বসবাস করতো। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতের বেলা ফুটপাতে শুয়ে আকাশের অগণন তারার দিকে চেয়ে আমু কল্পনা করতে ভালোবাসতো। শহরের যে ফুটপাতে শুয়ে তারা রাত্রিযাপন করতো তার পাশের চওড়া রাস্তাটাকে আমু ময়ূরাক্ষী নদী বলে মনে করতো। ঘুমের আবেশে চোখ বুজে সে যেন ময়ূরাক্ষীর কলতান শুনতে পেত। মন তার জেগে থাকত চেনা নদীর ধারে। কখনও কল্পনায়, কখনও নিশ্চিত নিশ্বাসে সে শুনতে পেত তার অবিশ্রান্ত মৃদু কলতান। সে দেখতে পেত নদীবক্ষে ভাসমান ডিঙি নৌকাগুলো। “এরই মধ্যে হয়তোবা ডিঙির খোদল ভরে উঠেছে বড় বড় চক্চকে মাছে।” এভাবে আমুর চোখের পর্দায় ভেসে উঠত চকচকে মাছে ভরা জেলে নৌকা। এমনিভাবে আমু ময়ূরাক্ষী ও নয়নচারা গ্রামকে কল্পনায় অনুভব করতো।
বাস্তবতায় বদলে যাওয়া আমু : শহরের নিষ্ঠুরতায় পোড়খাওয়া আমু শেষপর্যন্ত স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল। এখানে যে কান্নার কোন মূল্য নেই সে তা বু ঝতে পেরেছিল। এ শহরে কেউ কারও নয়। তাইতো ভিক্ষে না পেয়ে ভুতনি যখন খালি হাতে ফিরে এসে কান্না জুড়ে দিয়েছে আমু তখন তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নিজের গচ্ছিত পয়সা দিয়ে ভুতনিকে সে সাহায্য করেনি। “হ্যাঁ, দুটি পয়সা আমুর কাছে আছে বটে কিন্তু আমু তা দেবে কেন?” নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাছে কখনও কখনও এভাবে বদলে গেছে আমু।
ধৈর্যচ্যুত আমু : শহরের মানুষের নিষ্ঠুরতা আমুকে ধৈর্যচ্যুত করে ফেলেছিল। মানুষের অবহেলা, অবজ্ঞা তাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। শহরের মানুষগুলো তাকে মানুষ বলে মনে করে এজন্য আমু মনে মনে খুব কষ্ট পেত। একদিন একটা খাবারের দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমু ভেতরের দিকে তাকিয়েছিল। সহসা একটা লোক তার দিকে তেড়ে এল। লোকটা যেন অন্ধ । আমুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে পাগলা কুকুরের মতো লোকটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর বেদম মার খেয়ে আবার রাস্তায় নেমে এল।
সংবেদনশীল আমু : আমুর মধ্যে একটা সংবেদনশীল মন ছিল। এ মনটা তাকে সর্বদা মানুষের প্রতি উৎসুক করে রাখত। হোটেলের লোকটার হাতে মার খেয়ে আমু হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজাটা খুলে গেল । একটা মেয়ে তাকে কিছু খাবার দিল। মেয়েটাকে আমুর খুব চেনা বলে মনে হলো। তার সংবেদনশীল মন বলে উঠল নিশ্চয়ই এর বাপের বাড়ি নয়নচারা গ্রামে। আমুর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হলো, “নয়নচারা গাঁয়ে কি মায়ের বাড়ি?” মেয়েটা ভিক্ষে দিয়ে আবার ঘরের মধ্যে ফিরে গেল । আমুর মন তখনও মেয়েটাকে নিয়ে কল্পনার পাখায় ভর করে উড়ে চলছিল ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ‘নয়নচারা’ গল্পের আমু বিশেষ কোন চরিত্র নয়। এ চরিত্রের মধ্যে তেমন কোন বৈচিত্র্যও নেই। দুর্ভিক্ষপীড়িত একটা মানুষ শহরে গিয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে কষ্ট পেয়েছে। সম্পূর্ণ অচেনা জগতটা তার ভালো লাগেনি। জীবনের কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আমু জীবনের নিষ্ঠুরতম দিকটাকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছে। দুর্ভিক্ষতাড়িত আমু গ্রাম থেকে শহরে এলেও শহর তার কাছে অনাত্মীয়। গ্রামের উদারমুক্ত পরিবেশ এবং শান্তিই তার অন্বিষ্ট। তাই আমুর চরিত্রে ভিড় করে আছে চেতনা প্রবাহ, আর স্মৃতিময় অনুষঙ্গ। লেখকের মানস রূপায়ণে ‘আমু’ চরিত্র এক অনন্য সৃষ্টি।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a8%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%a8%e0%a6%9a%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a6%be-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%b8%e0%a7%88%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%a6-%e0%a6%93%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%be/