অথবা, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধ অনুসরণে সংস্কৃতির সাথে ধর্মের পার্থক্য নির্দেশ কর।
অথবা, ধর্মের সাথে সংস্কৃতির পার্থক্য কোথায়? মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে আলোচনা কর।
অথবা, ধর্মের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক কতটুকু? সংস্কৃতি ও ধর্মের কাজ কী তা মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধ অনুসরণে বুঝিয়ে দাও।
অথবা, “ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে মানুষকে বিকশিত করতে নয়”— এ উক্তির আলোকে সংস্কৃতি ও ধর্মের পার্থক্য নির্দেশ কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি প্রকৃষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত ধারা প্রবন্ধ সাহিত্য। এ ধারার একজন অন্যতম সংযমী প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব মোতাহের হোসেন চৌধুরী। যুক্তি ও চিন্তার শাণিত প্রকাশে তাঁর সৃষ্ট প্রবন্ধশৈলী বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সম্পদ। ‘সংস্কৃতি কথা’ তাঁর একটি অনন্য সৃষ্টি। এ প্রবন্ধে তিনি সংস্কৃতির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করতে গিয়ে ধর্মের সাথে সংস্কৃতির পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। আমরা সাধারণ মানুষ যে ধর্ম ও তার অনুশাসন মেনে চলি প্রাবন্ধিক সে ধর্মকে সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে দেখেছেন। তাঁর ভাষায় ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।
সংস্কৃতি : ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ইংরেজি ‘Culture’ শব্দের প্রতিশব্দ। সংস্কৃতি বা কালচারের সংজ্ঞা অনেক ব্যাপক। কারও মতে, জীবনের প্রকাশের নাম সংস্কৃতি। কেউ মনে করেন, সংস্কৃতি হচ্ছে সভ্যতার নির্যাস। আবার কেউ বলেছেন- সংস্কৃতি হলো প্রগতি ও পূর্ণতা লাভের একটি সচেতন কর্মপ্রয়াস। প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে, সংস্কৃতি মানে জীবনের Values অর্থাৎ মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা। শিক্ষিত ও মার্জিত লোকের যা ধর্ম তা-ই সংস্কৃতি।
ধর্ম : ধর্ম বলতে আমরা বিভিন্ন আধ্যাত্মিক মতবাদকে বুঝে থাকি। এ সকল মতবাদ সাধারণ মানুষ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। প্রাবন্ধিক মনে করেন ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। ধর্ম ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী। ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে পতন থেকে রক্ষা করতে- মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য।
সংস্কৃতির কাজ : সংস্কৃতি মানুষের ভিতরে একটা নিজস্ব জীবনদর্শনের জন্ম দেয়। সংস্কৃতির কাজ হচ্ছে মানুষকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা, মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। সংস্কৃতি মানুষকে বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে, সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়। সংস্কৃতি মানুষকে উদার, কর্তব্যপরায়ণ ও প্রেমিক করে তোলে। সংস্কৃতি উন্নততর জীবন ব্যবস্থার নির্মাতা। প্রগতি, সভ্যতা ও ধর্মচর্চার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে গভীরভাবে বেঁচে থাকা শেখানোই সংস্কৃতির কাজ। সংস্কৃতি মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে।
ধর্মের কাজ : ধর্ম মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। ধর্ম মানুষকে স্বর্গের লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে। ধার্মিক মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবনযাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। মানুষ ধর্ম পালন করে স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণির সিট রিজার্ভ করার আগ্রহে, অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ধর্মের প্রভাবে মানুষের মনে ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে একটা ইতর লোভ ক্রিয়াশীল থাকে। ধর্মের কাজ মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করা; মানুষকে বিকশিত করা ধর্মের কাজ নয়।
সংস্কৃতি ও ধর্মের পার্থক্য : সংস্কৃতি ও ধর্মের পার্থক্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ধর্ম সাধারণ লোকের সংস্কৃতি আর সংস্কৃতি বিবেকবান মানুষের ধর্ম। সংস্কৃতি মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা- সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্
বন্ধে অবহিতি। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ । সংস্কৃতি মানুষকে উদার করে, ধর্ম মানুষকে পঙ্গু করে। সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়, আর ধর্ম মানুষকে আপন অনুশাসন দ্বারা গৃহকোণে রুদ্ধ করে রাখে। সংস্কৃতিবান মানুষ তার কৃতকর্মের ফল পায় হাতে হাতে, আর ধার্মিক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফলের জন্য মৃত্যুর পর অপেক্ষা করে। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি তার নিজের স্বর্গ নিজেই মর্ত্যের মাটিতে তৈরি করে, আর ধার্মিক ব্যক্তির স্বর্গ তৈরি করে ধর্ম প্রবর্তকেরা। ধর্ম ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী, আর ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবন সাধনারই অপর নাম সংস্কৃতি। এছাদ
ধার্মিক ও সংস্কৃতিবান মানুষ : ধার্মিক ও সংস্কৃতিবান মানুষের একটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধন অনেক বেশি। উল্টো কথার মত শোনালেও কথাটি সত্য। ধার্মিকের আছে কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্ম চিন্তার বাঁধনে যে বন্ধন সে তো ফ্রি থ্রিংকিং সংস্কৃতির দান। যেখানে ফ্রি থিংকার আর ফ্রি থ্রিংকিং নেই সেখানে সংস্কৃতি নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হলো তাতে মনে হচ্ছে ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিবান হতে পারে না। কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। ধার্মিকদের মধ্যেও অনেক সংস্কৃতিবান লোক দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে সেখানেও সংস্কৃতিই সংস্কৃতিবান হওয়ার হেতু। অনুভূতি ও কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তাঁরা সংস্কৃতিবান, অন্য কারণে নয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, যা কিছু সুন্দর, মার্জিত এবং রুচিশীল তাই সংস্কৃতি এবং যা বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই ধর্ম। ধর্ম মানুষকে স্বর্গের লোড দেখিয়ে বশীভূত করে রাখে এবং সংস্কৃতি মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচতে শেখায়। ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।