অথবা, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ দুর্ভিক্ষতাড়িত ছিন্নমূল মানুষের অসহায়তার কাহিনি”— উক্তিটি অবলম্বনে ‘নয়নচারা’ গল্প সম্পর্কে একটি আলোচনা লিপিবদ্ধ কর।
অথবা, ‘নয়নচারা’ গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষদের যে জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন তা বর্ণনা কর।
অথবা, “সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্প দুর্ভিক্ষতাড়িত ছিন্নমূল মানুষের করুণ অসহায়তার কাহিনি”– উক্তিটির যথার্থতা যাচাই কর।
অথবা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পে অসহায় উদ্বাস্তু মানুষের জীবনযন্ত্রণার যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা আলোচনা কর।
অথবা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিরচিত ‘নয়নচারা’ গল্পে বিধৃত জীবনযন্ত্রণার পরিচয় দাও।
অথবা, ‘নয়নচারা’ গল্পের একটি মনোজ্ঞ আলোচনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার বিচিত্র অনুষঙ্গকে যারা ঐকান্তিক পর্যবেক্ষণে পরিস্ফুট করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁদের অন্যতম। জীবন সন্ধানী সমাজসচেতন এ শিল্পীর একটি অসাধারণ ছোটগল্প ‘নয়নচারা’। দুর্ভিক্ষতাড়িত উদ্বাস্তু মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তব আলেখ্য এ গল্পের মূল উপজীব্য।
গল্পের পটভূমি : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘নয়নচারা’ গল্পে বাংলাদেশের সমাজজীবনের করুণ চিত্র মূর্ত হয়ে উঠেছে। লেখকের স্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্যোগময় ঘটনা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ কবলিত নয়নচারা গ্রামের মানুষেরা শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়হীন এ হতভাগ্যদের একজন আমু। গল্পকার আমুকে সামনে নিয়ে মানুষের অসহায়ত্বের মর্মন্তুদ কাহিনি নির্মাণ করেছেন।
দুর্ভিক্ষতাড়িত ছিন্নমূল মানুষ : বাংলাদেশের শতকরা আশিভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী নয়নচারা এমনি একটি গ্রাম। এ গ্রামটিকে বন্যা গ্রাস করার কারণে এখানকার সব মানুষ উদ্বাস্তু হিসেবে শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু শহরে তাদের আশ্রয় দেবে কে? তাই তারা প্রশস্ত রাস্তার ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। লেখকের বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে তাদের উদ্বাস্তু জীবন। ‘ফুটপাতে ওরা সব এলিয়ে পড়ে রয়েছে। ছড়ানো খড় যেন।’ এরা আজ ছিন্নমূল মানুষ। এদের শহরে আসার কথা ছিল না। কিন্তু ভাগ্য তাদেরকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। শহরের জীবন সম্পর্কে এদের কোন ধারণা ছিল না। তাই এখানকার হৃদয়হীন মানুষের মুখোমুখি হয়ে আমু, ভুতনি, ভুতো যেমন বিস্মিত হয়েছে তেমনি হয়েছে ত্যক্তবিরক্ত। মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে তারা আহত হয়েছে। এখানকার মানুষেরা যে তাদেরকে মানুষ বলে জ্ঞান করে না এটা বুঝতে পেরে আমুর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছে।
মানুষের অসহায়ত্ব : হতভাগ্য অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো এক মুঠো খাবারের জন্য সারাদিন শহরের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকাতে চায় না। দুপুরে লঙ্গরখানা থেকে সামান্য যা আহার পায় তাতে পেটের ক্ষুধা বাড়ে বৈ কমে না। রাতে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে এরা আকাশের তারা দেখে, তখন এদের মনে পড়ে তাদের ফেলে আসা গ্রামের কথা। ঘনায়মান কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা।করতে বেশ লাগে। ময়ূরাক্ষী নদী তীরের নয়নচারা গ্রাম। এ গ্রামের মানুষগুলোর সাথে শহরের মানুষদের কোন মিল নেই। এখানকার মানুষের চোখে পাশবিক হিংস্রতা। অথচ নয়নচারার মানুষের দেহমনে।মায়া-মমতার অভাব ছিল না। আশ্রয়হীন অসহায় মানুষগুলোর কাছে এ শহর, এ শহরের মানুষেরা বিভীষিকা হয়ে দেখা দেয়।
উদ্বাস্তু মানুষের প্রতিক্রিয়া : দুর্ভিক্ষতাড়িত উদ্বাস্তু মানুষগুলো শহরের মানুষের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওরা ভেবে পায় না কি ওদের অপরাধ, কেন এরা ওদেরকে দ
েখলে দূর দূর করে তেড়ে আসে। আমু ভাবে আর ভাবে। শহরের মানুষের চোখে কুকুরের হিংস্রতা দেখতে পায় সে। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের এরা কুকুরের চেয়েও অধম মনে করছে। মনে মনে আমু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এখানে দোকানে দোকানে থরে থরে সাজানো খাবার। তা দেখতে গেলেও দোকানি তেড়ে মারতে আসে। আমুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তেড়ে আসা মানুষটার উপর। তারপর বেদম মার খেয়ে আবার রাস্তায় ফিরে আসে। তখন তার চোখ ফেটে
পানি পড়ে। নয়নচারার শান্ত-স্নিগ্ধ রূপটি মনে করে সে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
জীবনযন্ত্রণা : ‘নয়নচারা’ গল্পের কাহিনিতে দেখা যায়, শহরের ফুটপাতে যেসব মানুষ আশ্রয় নিয়েছে এরা সবাই এসেছে গ্রাম থেকে। দুর্ভিক্ষতাড়িত এসব ছিন্নমূল মানুষ তাদের সব হারিয়ে আজ সর্বহারা। এদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, ঠিকানা নেই- নেই জীবনের কোন নিশ্চয়তা। নয়নচারা গ্রাম থেকে এসেছে এদেরই একজন, যার নাম আমু। গল্পকার আমুর যন্ত্রণাকাতর জীবনের হাহাকারকে শিল্পিত করে তুলেছেন ভাষা ও বর্ণনায়। “Life is not a bed of roses”- ‘জীবন ফুলশয্যা নয়’ এ সত্যটি এ গল্পের যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষগুলোকে দেখে অনুভব করা যায়। জীবন এখানে বেদনার পারাবারে নিমজ্জিত, আশা এখানে হতাশার হাহাকারে মুহ্যমান। কঠিন বাস্তবতা এখানে জীবনকে করেছে রক্তাক্ত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দুর্ভিক্ষ-দীর্ণ নয়নচারাবাসী খাদ্যের সন্ধানে শহরে এলেও তাদের প্রত্যাশা প্রতিনিয়তই বিধ্বস্ত ও বিষণ্ন হয়েছে। নাগরিক আয়োজনপূর্ণ রাতের শহর উজ্জ্বল কিন্তু উদ্বাস্ত্ত মানুষের হৃদয় বেদনাক্লিষ্ট ও অপূর্ণ। তাই তারা নিরন্তর গ্রামাভিমুখী। এ হতভাগ্য উদ্বাস্তুদের দুরবস্থার কথাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর ‘নয়নচারা’ গল্পে বিবৃত করেছেন।