অথবা, দাসপ্রথার বৈশিষ্ট্যাবলি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা কর।
অথবা, দাসপ্রথার বৈশিষ্ট্যাবলি কী কী? বিস্তারিত আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রাচীন যুগ, প্রস্তরযুগ, নব্য প্রস্তরযুগ, ব্রোঞ্জযুগ ও লৌহযুগ ইত্যাদিতে সমাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। আবার ঐতিহাসিকেরা প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগে সমাজকে বিভক্ত করেছেন । বিখ্যাত
নৃবিজ্ঞানী L. H. Morgan তাঁর গ্রন্থগুলোর অন্যতম ‘Ancient Society’ গ্রন্থে সমাজ বিকাশের তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। যথা : বন্যদশা (Savagary), বর্বরদশা (Barbarism) এবং সভ্যতা (Civilization)। বস্তুত সমাজ হলো পরিবর্তনশীল বা বিবর্তনের ধারা। তবে সব সমাজে ক্রমধারায় একের পর এক পরিবর্তন আসবে একথা জোর করে বলা যায় না।
দাসপ্রথার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of slavery) : দাসপ্রথায় দাস ও মনিব এ শ্রেণিদ্বয় সমাজে সকল ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত ছিল। অবশ্যই এ ব্যবস্থায় দাসেরা মনিবের অধীনস্থ জীবনযাপন করতো এবং সকল উৎপাদন কাজে দাসের কায়িক শ্রমই ছিল প্রধান উৎপাদন শক্তি। ফলে দাস সমাজে খুব কমই সভ্যতা ছিল। নিম্নে দাস সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. মনিবের সম্পত্তি : দাসেরা মনিবের অধীনস্থ ও আজ্ঞাবহ। দাসের উপর মনিবের ক্ষমতা অসীম। তারা যেন মনিবের সম্পত্তি।
২. রাজনৈতিক অধিকার ছিল না : দাসদের রাজনৈতিক অধিকার বলতে কিছু নেই, তারা সরকার গঠন ও পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। জনসভাতে অংশ নিতে পারে না। সামাজিকভাবেও দাসেরা ঘৃণিত।
৩. শ্রম শোষণ : দাসপ্রথা জোরপূর্বক শ্রম শোষণের শামিল। দাসেরা পরাধীন। ইচ্ছা করলেও সে বিনাশ্রমে থাকতে পারে না। স্বাধীন শ্রমিকেরা ইচ্ছা করলে কোন বিশেষ সময়ের জন্য কাজ না করেও অবসর জীবন কাটাতে পারে। কিন্তু দাসদের মনিবের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতেই হয়। প্রভুর সম্পত্তি হিসেবে প্রভুর হুকুম পালন করাই তার কাজ।
৪. ক্রয়বিক্রয়ের পণ্য : দাসরা ছিল ক্রয়বিক্রয়ের পণ্য। দাস মালিকেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দাসদের ক্রয় করে এনে অধিক মুনাফার স্বার্থে অন্যদের কাছে বিক্রয় করতো।
৫. অর্থনৈতিক হাতিয়ার : দাসরা ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থের অন্যতম হাতিয়ার। সমস্ত অর্থনৈতিক কর্ম তাদেরকে ঘিরেই পরিচালিত হতো। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে গৃহের অভ্যন্তরে যতসব অর্থনৈতিক ক্রিয়া ছিল, সবই তাদের দ্বারা সংঘটিত হতো।
৬. নিগৃহীত ঘৃণিত : দাস মনিবেরা ছিল অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। দাসদের কাঁধের উপর ভর করেই তারা ভোগ বিলাসে লিপ্ত ছিল এবং তাদের চোখে দাস ছিল নিগৃহীত, ঘৃণিত। এ অভিজাত শ্রেণি সমাজের সকল ক্ষমতার অধিকারী ছিল । তারা প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যবসায় বাণিজ্য, কৃষিব্যবস্থা ও যুদ্ধবিগ্রহের মতো কাজ পরিচালনা করতো।
৭. ভোগের সামগ্রী : মানবসমাজের অর্ধেক হলো নারী। সভ্যতা নির্মাণে যাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য, যা১. মনিবের সম্পত্তি :রা কৃষি নামক শিল্পের সূচনাকারী, সেই অংশের উপর নির্যাতন বৈষম্য ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। নারীরা ছিল মনিবের ভোগের সামগ্রী, যখন ইচ্ছা তখন তারা নারীদের ভোগ করতে পারতো। যাদের চেহারা ভালো ছিল বা সুন্দরী ছিল তাদেরকে ব্যবসায়ী মুনাফার অন্যতম উপাদেয় বস্তু হিসেবে গণ্য করা হতো।
৮. শ্রেণিবিভক্তি : দাসপ্রথা বা ব্যবস্থা ছিল সমাজের প্রথম শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। সেখানে বিশেষত পাশ্চাত্যের গ্রিসে তিন ধরনের লোক বসবাস করতো। স্বাধীন নাগরিক (যাদের এক অংশ ছিল অভিজাত), দাস ও বিদেশি। এদের মধ্যে দাসের সংখ্যা ছিল বেশি। এরা ছিল উৎপাদনের প্রধান শক্তি।
৯. যুদ্ধবন্দি : বেশিরভাগ দাস ছিল যুদ্ধবন্দি। দাস সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল যুদ্ধবিগ্রহ। যুদ্ধটা মূলত হতো রাজ্যজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধবন্দিদের দাসে পরিণত করে ব্যবসা করা।
১০. আইনের স্বীকৃতি : দাসপ
্রথায় গির্জাকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো। সেখানে অভিজাতরা এটিকে পরিচালিত করতো এবং আইন প্রণয়ন করে দাসকে অধিকারের বস্তু হিসেবে স্বীকৃত করতো।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, মোটামুটিভাবে এগুলোই হলো দাসপ্রথার অন্যতম বিষয় বা বৈশিষ্ট্য। তবে সব জায়গায় দাস সমাজে একই রকম বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল না। ভারতবর্ষে দাসপ্রথার ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যায় ।