প্রশ্নঃ দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায়সমূহ আলোচনা কর ।
উত্তরা ভূমিকা : দাবিদা বাংলাদেশের একটি সরাবহ সামাজিক সমস্যা । এ সমস্যার ফলে কেবলমাত্র মানুষের মৌল চাহিদা পূরণ এবং মাত ও সামাজিক জীবনে বহু সমস্যা দেখা দিচ্ছে । অন্যভাবে বলা যায় , দারিদ্র্য নিজেই একটি সমস্যা নয় , বরং একই সাথে অন্যান্য বহু সমস্যার জন্মদাতা । সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায় নিয়ে দারিদ্র্য দূরীকরণে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
১. প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার : আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ ও তার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে , যার আবিষ্কার , আরবণ ও পূর্ণ ব্যবহার আজওরা যদি এসব নিজ সম্পদকে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে আহরণ করি , তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সজল হবে এবং কিছুটা হলেও পরিদ্রতা লাঘব হবে ।
২. জন সংখ্যা নয়ন্ত্রণঃ জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম রোধকল্পে প্রচলিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । মূলত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিবার পরিপ্রেক্ষিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ।
৩. জনশক্তিঃ জনশক্তি ও উন্নয়ন বাংলাদেশের দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব । এদেশের বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ উপযুক্ত দক্ষতার অভাবে বেকার হয়ে আছে । এদের মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে উৎপাদনশীল জনশক্তিতে পরিণত করা যায় । এদের কর্মসংস্থান হলেই দেশের দারিদ্র্য কমবে ।
৪. শিক্ষার উন্নয়ন : শিক্ষিত জাতি সচেতন ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী । চাহিদার সাথে সামন্তস্য রেখে পরিবেশ সৃষ্টি করে আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব । আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের সং অদৃষ্টবাদিতা দূর করে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী করে তোলা যায় । বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সম্পদে পরিণত করে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় , যা দারিদ্র্য হ্রাসের সহায়ক হবে ।
৫. যোগাযোগ , যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নঃ সুষ্ঠু যোগাযোগ , যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়া ব্যবসায় বাণিতা , বাজারণ , দুর্যোগ মোকাবিলা এবং উন্নত অর্থনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি করা সম্ভব নয় । বস্তুত পরিবহন , যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে এদেশে নাহিদ লাঘব করা সব ।
৬. সম্পদের সুষম বণ্টন : যে কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নীতিমালা অনুসারে দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য হ্রাস করা হলে দেশের ৯০ % মানুষের দারিদ্র্য লাঘব হবে । এমনকি আমাদের দেশে এভাবেও দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব ।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : বাংলাদেশে দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলা তথা দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে । কেননা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শক্তি ।
৮. কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন : বাংলাদেশের জাতীয় আয় ও কর্মসংস্থানের প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি । ২০১০-২০১১ অর্থবছরে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল ১৯.৯৫ শতাংশ । কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন বলতে বুঝায় লাগসই বীজ , উন্নত রাসায়নিক সার ও পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ । তাছাড়া আমাদের দেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর । কাজেই এদেশের অর্থনীতিতে উন্নয়ন করতে হলে প্রথমে কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি করতে হবে এবং এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে । গ্রামবাংলায় খাদ্য ঘাটতি পূরণ হবে এবং এতে করে দারিদ্র্যের চাপ বহুলাংশে কমে যাবে ।
৯. নারীদের কর্মসংস্থান : ২০১১ সালের পঞ্চম আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০০.৩ জন পুরুষের ক্ষেত্রে ১০০ জন নারী । অর্থাৎ এ থেকে বুঝা যায় , আমাদের দেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশই হলো নারী । কিন্তু তাদের অধিকাংশই কোন উৎপাদনশীল কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয় । তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা , বিশেষ করে গৃহকর্মের অবসরে ঘরে বসেই করা যায় । তেমনি অর্থকরী কাজের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কাজের ব্যবস্থা করা গেলে পরিবারের অসচ্ছলতা দূর হবে ।
১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা : বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আরেকটি অন্যতম প্রতিবন্ধক এবং দরিদ্রতা প্রসারের প্রধান কারণ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ । দারিদ্র্য কবলিত এদেশে প্রতি বছর এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যায় । এজন্য বনায়ন , বন্যা নিয়ন্ত্রণ , নদীর নাব্যতা হ্রাস , পানি সেচ ব্যবস্থা , গণ আশ্রয় কেন্দ্র , খাল খনন প্রভৃতি কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে । না হয় এদেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে ফসলের ক্ষতি ও অসংখ্য মানুষকে দরিদ্রতার কবল থেকে মুক্ত করা যাবে না ।
১১. গ্রামীণ উন্নয়ন : বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে তথা জাতীয় উন্নয়নে চাই গ্রামীণ উন্নয়ন । কেননা এদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে । অতএব সকল গ্রামে শিক্ষা , স্বাস্থ্য , চিত্তবিনোদন , অবকাঠামোগত উন্নয়ন , কর্মসংস্থান সৃষ্টি , কৃষি উন্নয়ন , ভূমি সংস্কার প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব ।
১২. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস : প্রতিটি দেশকেই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয় বৈদেশিক সাহায্যের ভিত্তিতে । আমাদের দেশেও উন্নয়ন পরিকল্পনার ৬০ % অর্থ বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর । তাই এ বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণও এর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , আদর্শ ও বাস্তবতার দিক দিয়ে দারিদ্র্য হ্রাসের উপযুক্ত নীতি হচ্ছে বর্তমানের দাবি যথাসম্ভব পূরণ করে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ পাকাপোক্ত করা । এজন্য সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের পাশাপাশি সকল জনগণকেও সচেতন হতে হবে । জনগণ যদি নিজের আত্মোন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে তাহলে সফলতা না এসে উপায় থাকবে না ।