অথবা, দল সমাজকর্ম কাকে বলে? সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে দল সমাজকর্মের উদ্ভব আলোচনা কর।
অথবা, দল সমাজকর্ম কী? সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে দল সমাজকর্মের ইতিবৃত্তি আলোচনা কর।
অথবা, দল সমাজকর্মের সংজ্ঞা দাও? সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে দল সমাজকর্মের উৎপত্তির ধারা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা। এটি এমন এক ধরনের পেশা যা ব্যক্তি, দল তথা সমষ্টির যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে এবং ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সদস্যদের বিকাশ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। এজন্য সমাজকর্মের কতকগুলো মৌলিক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দল সমাজকর্ম পদ্ধতি। এটি দলের সাথে কাজ করার একটি গঠনমূলক, ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। দল সমাজকর্ম সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কতকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় সদস্যদের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের
সামাজিক ভূমিকার উন্নয়ন ও দলীয় লক্ষ্যার্জনে সহায়তা করে।
দল সমাজকর্ম : দল সমাজকর্ম বলতে সাধারণত দলভুক্ত মানুষের সাথে শৃঙ্খলাপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক তথা পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার এক বিশেষ পদ্ধতিকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, দল সমাজকর্ম দলীয় সমস্যা সমাধান ও দলের উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সমাজকর্মের এমন একটি মৌলিক পদ্ধতি সেক্ষেত্রে গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, নৈপুণ্য, পেশাগত মূল্যবোধ ও নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী দল সমাজকর্ম সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
জিসলা কনোপকা (Gisela Konopka) তাঁর ‘Social Group: A Helping Process’ (1963 : 15) গ্রন্থে দল
সমাজকর্মের সংজ্ঞায় বলেন, “দল সমাজকর্ম হচ্ছে গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গকে তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন এবং ব্যক্তিগত, দলীয় বা সামাজিক সদস্যকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য এক ধরনের পদ্ধতি।”
ওয়াল্টার এ. ফ্রিডল্যান্ডার (Walter A. Friedlander) এর মতে, “দল সমাজকর্ম দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে মানুষকে সহায়তা করার এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে তারা (মানুষ) দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, আবেগ এবং দৈহিক বিকাশ সাধনের সাথে সাথে সমাজস্বীকৃত দলীয় লক্ষ্যার্জন করতে সক্ষম হয়।”
এইচ. বি. ট্রেকার (H. B. Tracker) এর মতে, “দল সমাজকর্ম এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে দলীয় বা-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় দল সমাজকর্মী কর্তৃক সাহায্য করা হয়। এর মাধ্যমে দল সমাজকর্মী দলীয় কার্যাবলিতে সদস্যদের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যাতে তারা নিজেদেরকে পরস্পরের সাথে
সম্পর্কিত করে, নিজেদের প্রয়োজন ও সামর্থ্যের সাথে সংগতি রেখে উন্নতি লাভে তথা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির উন্নয়নে সক্ষম হয়।”
মারজরি মারফি (Marjorie Murphy) দল সমাজকর্ম সম্পর্কে বলেন, “Social group work is enhancement of person’s social functioning through purposeful group experience.” অর্থাৎ, দল সমাজকর্ম হচ্ছে
গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গের সামাজিক ভূমিকা বৃদ্ধি করা।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, দল সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের এমন একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেখানে দলীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একজন দল সমাজকর্মী সুপরিকল্পিতভাবে দলীয় সমস্যার সমাধান করেন এবং দলের সদস্যদের উন্নতিকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যাতে তারা নিজেরা নিজেদের সমস্যা বুঝতে ও সমাধানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে দল সমাজকর্মের বিকাশ : দল সমাজকর্ম হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমাজকর্ম তার সেবা কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তি পর্যা
য়ে সেবা প্রদান করত। কিন্তু ধীরে ধীরে সমস্যার সঠিক ও কার্যকর সমাধানের জন্য পরবর্তীতে দলীয় পর্যায়ে সেবা প্রদান করা হতো। এটি ছিল
মূলত দল সমাজকর্ম বিকাশের প্রথম ধাপ। তবে পরিপূর্ণভাবে সমাজকর্মের পদ্ধতি হিসেবে দল সমাজকর্মের বিকাশ ঘটে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে। শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট বহুমুখী জটিল সমস্যা মোকাবিলা করার প্রেক্ষাপটে দল সমাজকর্মের বিকাশ ঘটেছে। নিম্নে দল সমাজকর্মের বিকাশ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
দলীয়ভাবে সেবার সংগঠিত ধারা শুরু হয় ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় ১৮৮০ সালের শেষলগ্নে বসতি আন্দোলন শুরু হওয়ার
মধ্য দিয়ে। এ আন্দোলন নতুন দেশে অভিবাসীদের জীবনে সংহতি আনতে যে সেবাকর্মের বীজ বপন করে তাতে বিকাশ ঘটে
দল সমাজকর্মের সূচনা পর্ব। এ সময় ইংল্যান্ডের টয়েনবি হল (১৮৮৪) এবং আমেরিকায় এডামস এর হাল হাউজ (১৮৮৯), চিকাগো শহর এলাকা ও অনুরূপ অন্যান্য প্রতিবেশীসুলভ কর্মতৎপরতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের সুষ্ঠু জীবন লাভ এবং বিনোদন ও
সাংস্কৃতিক সুবিধার ব্যবস্থা হয়। এতে গণতান্ত্রিক ভাবধারার দলগত অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেশী পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দলীয় উদ্যোগ গ্রহণ শুরু হয়। তাতে আত্মসাহায্য নির্ভরতা ও সামাজিক অবিচার থেকে পরিত্রাণ লাভকে
সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে সামাজিক, বিনোদনমূলক এবং শিক্ষা চাহিদা মোকাবিলায় দলসমূহ সংগঠিত হয়। আর
এ ধারায় দরিদ্র ও বসতি কর্মীরা বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যায়ে নিজের কর্মস্থল ও বাসস্থানের উন্নয়নে সংগঠিত হতে সহায়তা
পায়। সে কারণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বসতি স্থাপন আন্দোলনের একটি অংশ হিসেবে দল সমাজকর্ম চিহ্নিত হয়। ১৯২০ সালে আমেরিকার সমাজজীবনে আরও অগ্রসর হলেও অভিবাসন হার কমে গেলে দরিদ্র থেকে বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় হয়। তাতে বসতি আন্দোলন মানুষের জীবনের সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করতে
সচেষ্ট হয়। একই সাথে সে ধারাতে যুব বয়সীদের সামাজিকীকরণ এবং এরূপ বয়সী দলের অবকাশ যাপনে গড়ে উঠে YMCA, YWCA, বয়স্কাউট, গার্লস স্কাউট, 4-H ক্লাব এবং কমিউনিটি কেন্দ্রের মতো বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যা দল। সমাজকর্মের প্রারম্ভিক কর্মপ্রক্রিয়াকে জোরদার করে।
১৯৩৫ সালে আমেরিকায় ‘National Conference on Social Work’ এর অধীনে দল সমাজকর্মের একটা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল দ্রুত বিকাশমান দল সমাজকর্মের সহায়তার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা। ১৯৩৬ সালে আমেরিকার বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধির সমন্বয়ে ‘National Association for the Study of Group Work’ সংগঠিত করা হয়। দল সমাজকর্ম পদ্ধতির শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল সমাজকর্মী নিয়োগে সাহায্য করাই ছিল আলোচ্য সংগঠনের মূল লক্ষ্য। দল সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে জরিপ পরিচালনা ও সম্পাদনের মাধ্যমে দল সমাজকর্মের পদ্ধতিগত এবং শিক্ষাগত দিকের বিকাশে এ সংগঠন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। ১৯৪০ সালের শেষাংশে এসে অনেক বিতর্কের মধ্যেও দল সমাজকর্ম পেশাগত পরিচিত পায় এবং ১৯৪৬ সালে আমেরিকার দলকর্মী সমিতি জাতীয় সমাজকর্ম সম্মেলনে অবস্থান নেয়। তারপর সমাজকর্ম বর্ষপুস্তকে দল সমাজকর্মের একটি অংশ নির্দিষ্ট হয় এবং দ্রুত বিভিন্ন পুস্তক রচিত হওয়া শুরু হয় । দল সমাজকর্মের বিকাশের একটি পরিণতগত স্থিতি আসে ১৯৫০ এর পর থেকে। এ সময় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সমাজকর্ম পেশার সংগঠন এবং সমাজকর্ম শিক্ষা কাউন্সিল সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলনের উন্নয়নে বেশ তৎপর হয়ে উঠে।
এ সময়ে দল সমাজকর্মী দল সমাজকর্ম অনুশীলনকে অধিকতর পূর্ণতরভাবে ধারণায়নে সক্ষম হয় এবং পেশাগত নেতৃত্বদানের জন্য পদ্ধতি ও ভূমিকাসহ দলীয় প্রক্রিয়ার গতিশীলতা অনুধাবনে জ্ঞানের উৎস চ
িহ্নিত করতে সফলকাম হয়। এ থেকে
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও দল সমাজকর্মের অনুশীলন বৃদ্ধি পায় এবং কালক্রমে দল সমাজকর্ম ক্রমশ আরও সংগঠিত ও বিকশিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, দল সমাজকর্ম সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে দলীয় সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধান করার জন্য এবং দলের লক্ষ্যার্জনের অন্তরায়গুলো দূর করার জন্য দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বিকাশ লাভ করেছে। অন্যভাবে বলা যায়, দল সমাজকর্মের বিকাশ ঘটেছে মানবীয় সমস্যা মোকাবিলায় এক স্বতন্ত্র পন্থা অনুসরণের মধ্য দিয়ে যা সমবেত মিথস্ক্রিয়ার মূল্যকে স্বীকৃতি দিয়ে উদ্ভূত হয়।