অথবা, দল সমাজকর্ম কাকে বলে? বাংলাদেশের শিশু ও যুবকদের জন্য এ পদ্ধতি গুরুত্ব নির্দেশ কর।
অথবা, দল সমাজকর্ম কাকে বলে? বাংলাদেশের শিশু ও যুবকদের জন্য এ পদ্ধতি তাৎপর্য বর্ণনা কর ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম একটি সাহায্যকারী পেশা। এটি এমন এক ধরনের পেশা যা ব্যক্তি, দল তথা সমষ্টির যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে এবং ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সদস্যদের বিকাশ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য সমাজকর্মের কতকগুলো মৌলিক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দল সমাজকর্ম পদ্ধতি। এটি দলের সাথে কাজ করার একটি গঠনমূলক, ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। দল সমাজকর্ম সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কতকগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় সদস্যদের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের
সামাজিক ভূমিকার উন্নয়ন ও দলীয় লক্ষ্যার্জনে সহায়তা করে।
দল সমাজকর্ম : দল সমাজকর্ম বলতে সাধারণত দলভুক্ত মানুষের সাথে শৃঙ্খলাপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক তথা পরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার এক বিশেষ পদ্ধতিকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, দল সমাজকর্ম দলীয় সমস্যা সমাধান ও দলের উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচালিত সমাজকর্মের এমন একটি মৌলিক পদ্ধতি সেক্ষেত্রে গঠনমূলক ‘দলীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা, নৈপুণ্য, পেশাগত মূল্যবোধ ও নীতিমালা অনুসরণ করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী দল সমাজকর্ম সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
জিসলা কনোপকা (Gisela Konopka) তাঁর ‘Social Group : A Helping Process’ (1963 : 15) গ্রন্থে দল
সমাজকর্মের সংজ্ঞায় বলেন, “দল সমাজকর্ম হচ্ছে গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গকে তাদের সামাজিক ভূমিকা পালন এবং ব্যক্তিগত, দলীয় বা সামাজিক সদস্যকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য এক ধরনের পদ্ধতি।”
ওয়াল্টার এ. ফ্রিডল্যান্ডার (Walter A. Friedlander) এর মতে, “দল সমাজকর্ম দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে মানুষকে সহায়তা করার এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে তারা (মানুষ) দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, আবেগ এবং দৈহিক বিকাশ সাধনের সাথে সাথে সমাজস্বীকৃত দলীয় লক্ষ্যার্জন করতে সক্ষম হয়।”
এইচ. বি. ট্রেকার (H. B. Tracker) এর মতে, “দল সমাজকর্ম এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ব্যক্তিকে দলীয় বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় দল সমাজকর্মী কর্তৃক সাহায্য করা হয়। এর মাধ্যমে দল সমাজকর্মী দলীয় কার্যাবলিতে সদস্যদের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যাতে তারা নিজেদেরকে পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত করে, নিজেদের প্রয়োজন ও সামর্থ্যের সাথে সংগতি রেখে উন্নতি লাভে তথা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির উন্নয়নে সক্ষম হয়।”
মারজরি মারফি (Marjorie Murphy) দল সমাজকর্ম সম্পর্কে বলেন, “Social group work is enhancement of person’s social functioning through purposeful group experience.” অর্থাৎ, দল সমাজকর্ম হচ্ছে
গঠনমূলক দলীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যক্তিবর্গের সামাজিক ভূমিকা বৃদ্ধি করা।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, দল সমাজকর্ম হলো সমাজকর্মের এমন একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যেখানে দলীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একজন দল সমাজকর্মী সুপরিকল্পিতভাবে দলীয় সমস্যার সমাধান করেন এবং দলের সদস্যদের উন্নতিকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যাতে তারা নিজেরা নিজেদের সমস্যা বুঝতে ও সমাধানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশে শিশু ও যুবকদের জন্য দল সমাজকর্মের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব : বাংলাদেশে পেশাদার সমাজকর্মের প্রয়োগ খুব একটা নেই একথা সত্য। তবে আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতকটা সংগঠিত এবং কতকটা অসংগঠিতভাবে দল সমাজকর্মের অনুশীলন হয়ে থাকে এবং এদেশে দল সমাজকর্মের কাজ করার জন্য বহু ক্ষেত্র রয়েছে। নিম্নে বাংলাদেশে শিশু ও যুবকদের জন্য দল সমাজকর্মের প্রয়োজনীয়তা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো :
শিশুদের ক্ষেত্রে : নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সরকারি শিশু সদন : আমাদের দেশে সরকারিভাবে পরিচালিত কয়েকটি শিশু সদন রয়েছে। যেখানে মাতৃপিতৃহীন শিশুদের অথবা পিতৃহীন শিশুদের লালনপালন করা হয়। এখানে এসব শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ, সামাজিকীকরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। কারণ একজন দল সমাজকর্মী তার পেশাগত জ্ঞান দ্বারা এসব শিশুদের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বন্ধন রচনা করতে সক্ষম। তিনি এসব শিশুদের সামাজিকীকরণের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম যথেষ্ট দক্ষতার সাথে পরিচালনা করে দলকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তা করতে পারেন।
২. ছোটমণি নি
বাস : এটি পাঁচ বছর বয়স বা তার নিচের শিশুদের জন্য পরিচালিত একটি কার্যক্রম। বিভিন্ন পরিত্যক্ত, অসহায়, দুস্থ ও এতিম শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে এ প্রতিষ্ঠান। এসব শিশুদের জন্য একটি সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশ প্রদানের মাধ্যমে তাদের মানবীয় বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিতকরণের জন্য দল সমাজকর্ম প্রয়োগ করা যেতে পারে। দল সমাজকর্মীর সহায়তায় তাদের Adjustment বিষয়ে সক্ষম করে তোলা যায়। তাছাড়া তাদের জন্য স্নেহ- ভালোবাসা, চিত্তবিনোদন এবং উপযুক্ত শিক্ষা প্রবর্তন করে সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনে দল সমাজকর্ম কাজ করে থাকে।
৩. শিশু কিশোর সংশোধন : আমাদের দেশে যেসব শিশু কিশোর অপরাধী আছে তাদের সংশোধনের জন্য সরকারি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে দল সমাজকর্ম পদ্ধতি ব্যবহার করে অপরাধী শিশু কিশোরদের আচার আচরণ সংশোধনে দল সমাজকর্ম প্রয়োগ করা যায়। এতে দলীয় পরিবেশে অপরাধী কিশোর কিশোরীরা তাদের আদর্শ ও মূল্যবোধগত পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম হয়। দল সমাজকর্মী তাদের মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনায়
আগ্রহীকরণের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়ে থাকেন।
যুবকদের ক্ষেত্রে : আমাদের যুবসমাজকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যুব পুরুষ ও যুব মহিলা। এদের দু’পক্ষের কল্যাণের ক্ষেত্রেই দল সমাজকর্মের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যুবকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক, নৈতিক সার্বিক কল্যাণের জন্যই দল সমাজকর্ম সহায়তা করতে পারে। আমাদের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বেকার যুবক। বেকারত্ব আমাদের গোটা জাতির জন্য বিপদ ও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে এ যুবশক্তি আজ সামাজিক ধ্বংসাত্মক, নাশকতামূলক কাজে ব্যয়িত হচ্ছে। এসব যুবকদের গঠনমূলক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে দল সমাজকর্মের প্রয়োজন খুবই জরুরি। দল সমাজকর্মের আওতায় নিয়ে এসে এদের মাধ্যমে এক একটা দল গঠন করে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি ও কার্যক্রম নির্ধারণকরণে দল সমাজকর্ম সহায়ক হতে পারে। দল সমাজকর্মের কৌশল প্রয়োগ করে যুব পুরুষদের জন্য বিভিন্ন যৌথ উদ্যোগে ফার্ম, খামার স্থাপন করে তাদের পুনর্বাসনে সহায়তা করা যায়। যুব মহিলাদের জন্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প স্থাপনে তাদের যৌথভাবে সংগঠিত করা, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যক্তিগতভাবে গরু-ছাগল পালন ইত্যাদি কার্যক্রমে নিয়োজিতকরণে দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করা সম্ভব।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, দল সমাজকর্মে দলীয় সদস্যদের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করা হয়। অর্থাৎ দল সমাজকর্মের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দলের সদস্যদের সার্বিক কল্যাণ করা। তাছাড়া যেহেতু শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ এবং যুবকরা কল্যাণের মূল কর্ণধার, তাই দল সমাজকর্মের মাধ্যমে শিশু ও যুবকদের কল্যাণসাধন
করা হয়।