দল বা গোষ্ঠীর সংজ্ঞা দাও। দলের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

অথবা, দল বা গোষ্ঠী কাকে বলে? দলের সাধারণ মানদণ্ড আলোচনা কর।
অথবা, দল বা গোষ্ঠী কী? দলের সাধারণ বিষয়বস্তু আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাধারণত দল বলতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝে থাকি। সামাজিক কারণেই ব্যক্তিকে কোন না কোন দলের সদস্য হিসেবে বসবাস করতে হয়। ব্যক্তিকে কোন একটি দলের সদস্য ছাড়া কল্পনা করা যায় না। “Groups are necessary part of social life.” তাই সামাজিক জীবনে দল একটি পরিচিত ও
বহুল ব্যবহৃত শব্দ।
দল বা গোষ্ঠী (Group) : সাধারণ অর্থে যখন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি পরস্পর সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সচেতন হয় এবং তার ফলে তাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধের আবির্ভাব ঘটে, তখন সে ব্যক্তির সমষ্টি বা সমাবেশকে গোষ্ঠীরূপে আখ্যায়িত করা যায়। পরিবার, ছাত্র পরিষদ, জনতা বা পরস্পরের সম্পর্কে সচেতন এবং সম্বন্ধযুক্ত একই ট্রেনের কামরার যাত্রীবৃন্দ
দলের উদাহরণ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন তাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী ও মনীষীগণ দল বা গোষ্ঠীর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকজনের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
সমাজ মনোবিজ্ঞানী কিম্বল ইয়ং (Kimball Young) বলেছেন, “আদমশুমারিতে যেমন জনসমষ্টির গণনা থাকে, দল সে রকম নিছক কোন জনসমষ্টি নয়। এটা হলো সংঘবদ্ধ কিছু লোক। যাদের মধ্যে কিছু লোক, যাদের মধ্যে কিছু মাত্রায় দেওয়া নেওয়ার ব্যাপার আছে, অর্থাৎ যাতে দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক উদ্দীপনা সৃষ্টি ও প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক আছে।” সে উদ্দেশ্যে তিনি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে দুই বা ততোধিক ব্যক্তিকে দল বলে গণ্য করেছেন।
এম সেরিফ (M. Sherif) এর মতে, “দল এমন একটি সামাজিক একক যাতে প্রত্যেকটি ব্যক্তি এক একটি বিশেষ পদমর্যাদা ও ভূমিকা পালনের (কম বা বেশি) সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত এবং কিছু মূল্যবোধ ও আদর্শ দ্বারা দলের প্রতিটি সদস্যের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয়।”
দলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য (Some characteristics of group) : দলের কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. অখওতার চেতনা : দলের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ‘আমরা কোনকিছুর অংশস্বরূপ’ এ মনোভাব। দলের অন্তর্ভুক্ত সভ্যদের মনে এক অখণ্ডতা বা সমগ্রতার চেতনা সৃষ্টি করে। যখন কোন ব্যক্তি কোন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয় বা তার মধ্য থেকে কাজ করে তখন সে উপলব্ধি করে যে সে কেবল নিজেকে নিয়েই কেন্দ্রীভূত নয়, সে এক অখণ্ড সমগ্রতার অংশস্বরূপ যা কোন কোন সময় তার ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কিছু করতে পারে না।
২. আমরা ভাব : গোষ্ঠীর মধ্যে একটা ‘আমরা ভাব’ থাকে যেটি গোষ্ঠীর অখণ্ডতা রক্ষা করতে সহায়তা করে। গোষ্ঠীর প্রতিটি সভ্য গোষ্ঠীর সাথে একাত্মতাবোধ করে। গোষ্ঠীর সুখ তার কাছে সুখ এবং গোষ্ঠীর দুঃখ তার কাছে দুঃখ
হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- কোন ক্লাবের ফুটবল খেলোয়াড়রা খেলায় জিতলে ক্লাবের প্রতিটি সভ্য আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠে, যদিও ফুটবল খেলায় সে নিজে কোনরকম সক্রিয় অংশগ্রহণ করে নি। গোষ্ঠী যতই ছোট হয় ‘আমরা ভাবটা’ ততই প্রবল হয়।
৩. দলীয় মনোভাব : গোষ্ঠীর অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠী তার সভ্যদের মধ্যে একটা দলীয় মনোভাব বা চেতনার সঞ্চার করে। গোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ পরস্পরের সাহচর্য পছন্দ করে, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ও শ্রদ্ধাশীল হয়, গোষ্ঠীর সাধারণ জীবনের অংশীদার মনে করে গর্বিত বোধ করে। প্রতিটি সদস্যই গোষ্ঠীর মধ্য থেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েই ব্যক্তি নিজের স্বার্থের কথা বিস্মৃত হয়ে গোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থের সাথে নিজের স্বার্থকে অভিন্ন মনে করে।
৪. পারস্পরিক ভাব বিনিময় : পরস্পরের আবেদনে সাড়া দেওয়া, পরস্পরের ভাব বিনিময়ে ক্রিয়া করা গোষ্ঠীর সংহতি বা ঐক্যের ভিত্তিস্বরূপ। গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে প্রথম শুরু হয় সংযোগ বা ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া, কিন্তু অচিরেই সভ্যরা উপলব্ধি করে যে পারস্পরিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। অপরের আচরণের সাথে নিজের আচরণের সামঞ্জস্য সাধন, গোষ্ঠীর সাধারণ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের কথা স্মরণ রেখে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা, গোষ্ঠী সংহতি বা ঐক্য সংরক্ষণের জন্য একান্ত প্রয়োজন। মোটামুটি স্থায়ী কোন গোষ্ঠীর সভ্যদের মধ্যে এ পারস্পরিক আদানপ্রদানের ভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৫. সভ্যর কার্যকলাপের উপর চাপ : গোষ্ঠীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গোষ্ঠীর সভ্যবৃন্দের এ চেতনা থাকে যে গোষ্ঠী তার অন্তর্ভুক্ত সভ্যদের কার্যকলাপের উপরে চাপ দিতে পারে। ব্যক্তির উপর এ চাপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আসতে
পারে। ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে, স্বাধীনভাবে খুশিমতো যে কোন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয় এবং সমষ্টিগত স্বার্থের সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তিস্বার্থকে অনেক সময় বিসর্জন দিতে হয় বা ব্যক্তিকে স্বার্থমূলক কার্যসম্পাদন থেকে বিরত থাকতে হয়।
৬. বিশেষ পরিবেশ : যখন কোন দলের সদস্যরা, বিশেষ করে কোন ছোট দলের সদস্যরা একত্রে মিলিত হয়, তখন একটা বিশেষ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি অনুভব করে। অবশ্য এ পরিবেশ ‘ধরাছোঁয়ার’ বাইরে, কোন বিশেষ প্রত্যক্ষগোচর মূর্তি নিয়ে এর আবির্ভাব ঘটে না। তবে ব্যক্তি আচরণের উপর প্রভাব ও
ফলাফল প্রত্যক্ষ করে এর অস্তিত্ব অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে। একে নিছক রহস্যময় বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে না। হয়ত গোষ্ঠীর সহযোগিতার ফলরূপেও এ পরিবেশকে মনে করা যেতে পারে।
৭. গোষ্ঠীর কাজে অংশগ্রহণকারী : গোষ্ঠী জীবনের অপর বৈশিষ্ট্য হলো গোষ্ঠীর সাধারণ কাজকর্মে সভ্যদের অংশগ্রহণের ইচ্ছা ও আগ্রহ। এ অংশগ্রহণের আগ্রহ স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে বা সুনির্দিষ্ট নীতি বা আদেশের ফলেও হতে পারে। অনেক গোষ্ঠীতে সভ্যদের কর্তব্যের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, গোষ্ঠীর মাধ্যমেই একজন সভ্য তার সুখ দুঃখ অনুভব করে, আচার আচরণ নিয়মনীতি শিক্ষা করে। গোষ্ঠীর প্রভাব ছাড়া মানুষ হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যাবলির আলোকেই একজন সভ্য তার গোষ্ঠীর মধ্যে জীবন অতিবাহিত করে থাকে। তাই গোষ্ঠীর গুরুত্বও অনস্বীকার্য।