দলের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, দলের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া বর্ণনা কর।
অথবা, দলের ইতিবাচক অন্তঃক্রিয়া আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক দল হলো পরিবর্তনশীল দলীয় সম্পর্কের প্রবাহ। তবে কোন দলই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনা আপনি গতিশীল থাকতে পারে না। দলীয় কাঠামোর ভিত্তিতে সদস্যদের মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। দলীয় উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি সংগঠিত মিথস্ক্রিয়ায় দলকে গতিশীলতা দান করে। মূলত দলীয় মিথস্ক্রিয়া ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে দলীয় গতিশীলতা আনয়নে ভূমিকা রাখে।
দলের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া : সামাজিক সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজে বসবাস করতে গিয়ে বিভিন্ন সামাজিক দল ও সামাজিক গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এসব গোষ্ঠী ও দলের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক জীবন অতিবাহিত হয়। প্রত্যেক সামাজিক দলের কতকগুলো নিয়মকানুন, বিধিবিধান ও আদর্শ থাকে। দলের সদস্যদের এসব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। দলীয় আচার আচরণে একটি ধারা অনুসরণ করতে হয়। দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক আচার আচরণ
পরস্পরকে প্রভাবিত করে। দলীয় সদস্যদের আচরণগত পারস্পরিক প্রভাব প্রতিক্রিয়া হলো দলীয় মিথস্ক্রিয়া। ফলে দু’ধরনের মিথস্ক্রিয়া দেখা যায়। একটি হলো ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া এবং অন্যটি হলো নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া। এ দু’ধরনের মিথস্ক্রিয়াই দলীয় গতিশীলতা আনয়নে ভূমিকা রাখে। নিম্নে দলীয় গতিশীলতা আনয়নে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়ার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
দলে ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া : দলীয় ইতিবাচক যেসব ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া ঘটে সেগুলোর ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যথা : ১. সহযোগিতা,
২. ঐকমত্য বা অভিন্ন সিদ্ধান্ত,
৩. আত্তীকরণ বা সাদৃশ্যকরণ এবং

  1. উপযোজন।
    ১. সহযোগিতা (Cooperation) : সহযোগিতার মাধ্যমেই মূলত দলীয় জীবনের সূত্রপাত ঘটে। সহযোগিতাকে দলীয় জীবনের মূলভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। দলীয় গতিশীলতা ও দলীয় স্থায়িত্ব সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। দলীয় সদস্যদেরকে দলীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরস্পরকে সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হয়। অভিন্ন লক্ষ্য ও
    উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে সহযোগিতামূলক মিথস্ক্রিয়ার সূত্রপাত। দলীয় সহযোগিতা সদস্যদের মধ্যে একাত্মতা, ভ্রাতৃত্ববোধ,
    ঐক্যবোধ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতাবোধের জন্ম দেয়। সহযোগিতা একদিকে যেমন দলীয় সংহতি বিধানের জন্য উত্তম প্রক্রিয়া তেমনি এটি দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যও প্রয়োজন। মূলত পারস্পরিক সহযোগিতার কারণেই দল টিকে থাকে, দলের লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং দল বেগবান হয়। সহযোগিতা দলীয় লক্ষ্য অর্জনের মূল চালিকাশক্তি। সহযোগিতার বন্ধন দলে যত সুদৃঢ় হবে দল তত শক্তিশালী হবে এবং দলে সহযোগিতার বন্ধন শিথিল
    হলে দলের অস্তিত্বই বিলীন হতে পারে।

২. ঐকমত্য বা অভিন্ন সিদ্ধান্ত (Consensus) : ঐকমত্য বা অভিন্ন সিদ্ধান্ত অনেকটাই দলীয় সহযোগিতার সাথে সংগতিপূর্ণ। দলীয় সদস্যরা পরস্পর ভিন্ন মতামত প্রদর্শন করলেও অনেক সময় দলীয় স্বার্থে কিংবা গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সদস্যদের পারস্পরিক স্বার্থের সমঝোতা বা সমন্বয়
সাধনের মাধ্যমে অভিন্ন সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘Social Work Dictionary’ প্রদত্ত ব্যাখ্যানুযায়ী, “Consensus is the process in which individuals and groups achieve general agreement about goals of mutual interest and the means to achieve them.”
৩. আত্তীকরণ বা সাদৃশ্যকরণ (Assimilation) : দলীয় ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়ার একটি বিশেষ রূপ হলো
আত্তীকরণ। ‘Social Work Dictionary’ এর ভাষ্যমতে, “Assimilation is the social integration or adoption of one group values norms and folkways by another group. For example a group of
immigrants may eventually integrate with or adopt many aspects of the culture of their new society.” সমাজবিজ্ঞানী অগবার্ন ও নিমকফ এর মতে, “আত্তীকরণ এমন এক প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় একদা যেসব ব্যক্তি বা দলের মধ্যে বৈসাদৃশ্য ছিল তাদের মধ্যে সাদৃশ্য আসে এবং পরস্পরের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমতা স্থাপিত হয়। এর মাধ্যমে দলীয় সংহতি স্থাপিত হয়।” এটি দলীয় গতিশীলতা আনয়নে ভূমিকা রাখে।
৪. উপযোজন (Accommodation) : যেসব আচরণ বা কার্যাবলির দ্বারা মানুষ তার পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ায় ঐসব কার্যাবলি বা আচরণকে বুঝার জন্য মনস্তত্ত্ববিদ Baldwin সর্বপ্রথম এ পদটি ব্যবহার করেন। উপযোজন হলো সামঞ্জস্য বিধান বা খাপ খাওয়ানো, যা মানুষ সামাজিক সূত্রে অর্জিত আচরণ কিংবা নতুন কোন আচরণ গ্রহণ করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানী অগ ও নিমক্ফ তাদের ‘A Hand Book of Sociology শীর্ষক গ্রন্থে উপযোজন সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “Accommodation is a term used by the sociologist to describe the adjustment of hostile individuals or groups.”
উপযোজন ছাড়া সমাজজীবন সম্ভব নয়। সমাজে সংঘর্ষ, কলহ, যুদ্ধবিগ্রহ স্বাভাবিক এবং চিরন্তন। উপযোজনের দ্বারা শুধু সামাজিক সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করাই যায় না, বরং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অস্তিত্বকে নিশ্চিত করা যায়। এভাবে পরস্পরবিরোধী দুই স্বার্থবাদী মহলের ভিতর সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, দলীয় জীবনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া থাকা খুবই স্বাভাবিক। এসব মিথস্ক্রিয়া দলীয় গতিশীলতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এগুলো ছাড়া দল স্থবির হয়ে যায়। তবে একথা সত্য যে, নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া অনেক সময় দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে
রাখা প্রয়োজন। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের মিথস্ক্রিয়াই দলীয় গতিশীলতা সৃষ্টিতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।