অথবা, দলীয় দ্বন্দ্ব কাকে বলে? দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন কর।
অথবা, দলীয় দ্বন্দ্বের সংজ্ঞা দাও? দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের তাৎপর্য মূল্যায়ন কর।
অথবা, দলীয় দ্বন্দ্ব বলতে কী বুঝ? দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের প্রভাব বর্ণনা কর ।
উত্তর৷ ভূমিকা : যেসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় মিথস্ক্রিয়া সম্পাদিত হয় সেগুলোর মধ্যে দলীয় দ্বন্দ্ব অন্যতম। সমাজজীবনে বা দলীয় জীবনে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার নেতিবাচক দিক হলো দলীয় দ্বন্দ্ব। এটি দলীয় গতিশীলতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নানাবিধ কারণে দলীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এটি দলের এমন একটি অবস্থা যা দলের সদস্যদের মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে এবং সমস্ত দলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে দলের সদস্যদের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। এবং দলীয় গতিশীলতার ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এজন্য সঠিক উপায়ে যথাসময়ে দলীয় দ্বন্দ্ব নিরসন করা জরুরি।
দলীয় দ্বন্দ্ব : দলীয় মিথস্ক্রিয়ার একটি বিশেষ প্রক্রিয়া হলো দলীয় দ্বন্দ্ব। সাধারণভাবে দলীয় দ্বন্দ্ব বলতে দলীয় সদস্যদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ আচরণ, মনোভাব ও কর্মকাণ্ডকে বুঝায়। দলীয় দ্বন্দ্বকে সহযোগিতার বিপরীত সামাজিক কার্যপ্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। যুদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মারমুখিতা ইত্যাদিকে দলীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে দলীয় দ্বন্দ্বের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকজনের সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো :
মনীষী এ. ডব্লিউ. গ্রীণ (A. W. Green) তাঁর ‘Sociology An Analysis of Life is Modern Society’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে বলেন, “Conflict is the deliberate attempt to oppose, resist or coerce the will of others.” অর্থাৎ, দ্বন্দ্ব হলো অন্যের ইচ্ছাকে সচেতনভাবে অবদমন, প্রত্যাখ্যান বা প্রতিরোধ করার প্রচেষ্টা। সমাজবিজ্ঞানী পি. বি. হর্টন ও সি. এল. হান্ট (P. B. Horton & C. L. Hunt) তাঁদের ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেন, “Conflict is the process of seeking to monopolise reward by eliminating or weaking one competitors.” অর্থাৎ, দ্বন্দ্ব হলো প্রতিযোগীদের উচ্ছেদ বা দুর্বল করার মাধ্যমে একচ্ছত্র পুরস্কার লাভের প্রত্যাশা চালানোর প্রক্রিয়া। সমাজবিজ্ঞানী গিলিন ও গিলিন (Gillin and Gillin) তাঁদের ‘Cultural Sociology’ গ্রন্থে বলেন, “Conflicts is the social process in which individual or group seek their end by directing challenging the antagonist by violence or threat of violence.”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, দলের অভ্যন্তরে দলীয় কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে দলের সদস্যরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে সংঘাতমূলক, হিংসাত্মক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক, বিরোধ আচরণ ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া করে তাকে দলীয় দ্বন্দ্ব বলে
দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের গুরুত্ব : দলীয় জীবনে দ্বন্দ্ব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। দ্বন্দ্ব দলকে গতিশীল করে এবং গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। নিম্নে দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের গুরুত্ব তোলে ধরা হলো
১. দলীয় সংহতি রক্ষা : দলীয় জীবনে দ্বন্দ্ব পরোক্ষভাবে দলকে স্থিতিশীল রাখে বা দলীয় সংহতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। দলের মধ্যে উদ্ভূত সাময়িক দ্বন্দ্ব দলনেতাকে সজাগ রাখে এবং তার নীতিমালাকে Up to date করতে সহায়তা করে। এ প্রসেঙ্গ C. N. Shankar Rao তাঁর ‘Sociology : Primary Principles’ (2003 : 259) গ্রন্থে
বলেছেন, “A limit amount of internal conflict indirectly contribute to group stability. An occasional conflict within the group may keep its leadership alert and its policies up to date.”
২. দলীয় সদস্যদের মধ্যে একতা বৃদ্ধি : আন্তঃদ্বন্দ্ব দলীয় সদস্যদের মধ্যে একতার বন্ধন শিথিল করলে বহিঃদ্বন্দ্ব (External conflict) দলীয় সদস্যদের মধ্যে একতার বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। এ প্রসঙ্গে C. N. Shankar Rao (2003 : 259) বলেছেন, “External conflicts brings about social unity are oneness among the members.” উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দল পাকিস্তানকে এবং ভারতের সকল রাজনৈতিক দল ভারতকে সাপোর্ট করে। আমরা যে দলে অবস্থান করি সে দলের ভিতর সমস্যা থ
াকলেও সে দল
যদি অন্য দলের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন কিন্তু আমরা নিজ দলের পক্ষেই কথা বলি। এভাবে বহিঃদ্বন্দ্ব দলীয় সদস্যদেরকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে সাহায্য করে।
৩. মূল্যবোধগত পরিবর্তন : সমাজবিজ্ঞানী H. T. Majumdar তাঁর ‘Grammar of Sociology’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, “দ্বন্দ্ব মূল্যবোধ সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন সূচিত করে।” অর্থাৎ দলীয় দ্বন্দ্ব মূল্যবোধের পরিবর্তনে সহায়তা করে।
৪. পারস্পরিক মর্যাদার পরিবর্তন সাধন ক্ষেত্রে : বিবদমান দুটি পক্ষের পারস্পরিক মর্যাদার পরিবর্তন সাধন ক্ষেত্রেও দ্বন্দ্বের ভূমিকা রয়েছে।
৫. সমাজ বা সামাজিক সংস্থার সম্প্রসারণ : বৃহত্তর সামাজিক সংস্থাগুলোতে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে অনেক সময় নতুন সামাজিক সংস্থার জন্ম হয়। বাংলাদেশে এনজিওদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি মাত্র সংস্থা ছিল এডাব (ADAB)। এ এডাবে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে বর্তমানে এনজিও ফোরাম নামে আরো একটি বৃহৎ সংস্থার জন্ম হয়েছে। এভাবে দ্বন্দ্বের ফলে
সমাজ বা সামাজিক সংস্থার সম্প্রসারণ ঘটে।
৬. নতুন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি : ড. অনাদি কুমার মহাপাত্র তাঁর ‘বিষয় সমাজতত্ত্ব’ (২০০০: ৪৯৪) নামক গ্রন্থে
T. B. Bottomore এর উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেছেন, “সমাজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও দ্বন্দ্বের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বলা হয় যে, দ্বন্দ্বের পরিণতি হিসেবে সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন ভাব-ভাবনা, মৌল মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা প্রভৃতির উন্মেষ ঘটে এবং এভাবে সৃষ্টি হয় এক নতুন সমাজব্যবস্থার। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বা সংগ্রামের অবদান অস্বীকার করা যায় না। এভাবে দ্বন্দ্বের ফলে নতুন
নতুন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়।”
৭. দলীয় স্বার্থরক্ষা : দলীয় সদস্যদের স্বার্থের ব্যাপারে দ্বন্দ্ব দল বা গোষ্ঠীকে সতর্ক রাখে। ফলে তা দলীয় স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
৮. প্রতিযোগিতা : দলীয় দ্বন্দ্ব অনেক সময় দলীয় সদস্যদেরকে তাদের ভূমিকা পালন ও কার্যসম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের জন্ম দেয়। এতে সদস্যদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়।
উপসংহার :পরিশেষে বলা যায়, দলীয় জীবনে দ্বন্দ্বের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে, দলের ভাঙনের জন্য এবং দলীয় সদস্যদের সম্পর্কের শিথিলতার জন্য দ্বন্দ্বই দায়ী। দ্বন্দ্বের কারণেই বিভিন্ন সময় রক্তক্ষয় ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটে; দ্বন্দ্বই সহযোগিতার স্বাভাবিক মাধ্যমগুলো দুর্বল করে দেয় এবং দ্বন্দ্বই সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। তাই ব্যক্তিগত, অন্তঃদ্বন্দ্ব বা বহির্দ্বন্দ্ব যে কোন দ্বন্দ্বই হোক না কেন তা নিরসনের ব্যবস্থা করা জরুরি।