তুমি কি মনে কর লাহোর প্রস্তাবে অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান ছিল? এ প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল? আলোচনা কর?

অথবা, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সীমাবদ্ধতা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় লাহোর প্রস্তাব একটি ঐতিহাসিক স্থান দখল করে আছে। লাহোর প্রস্তাব ছিল’ ভারতীয় মুসলিমদের দাবি ও অধিকার পাওয়ার প্রস্তাব। লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারতের উত্তর পশ্চিম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা। কিন্তু পরবর্তীতে এ প্রস্তাবে বেশকিছু অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা দেখতে পাওয়া যায়। শুরুতে প্রস্তাবটিতে একাধিক মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে গণমাধ্যম ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এটিকে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব বলে অভিহিত করতে থাকে। আবার লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম, কিন্তু অঙ্গরাজ্য
সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম হতে পারে না। ফলে কার্যত লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে পূর্ব বাংলার নেতৃত্বের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়।
লাহোর প্রস্তাবের অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন এ. কে. ফজলুল হক । লাহোর প্রস্তাবটিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের দাবি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে লাহোর প্রস্তাবে কিছু অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। নিচে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র : লাহোর প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা বলা হয়। মূলত উত্তর-পশ্চিম মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং অন্যটি হলো উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চেতনা প্রকাশ পায়। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবে এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা উল্লেখ করা হয়নি কোন কোন প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে। প্রদেশগুলোর সীমানা কেমন হবে। বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ কিভাবে বিভক্ত হবে তা সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না। যা লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম সীমাবদ্ধতা।
২. সার্বভৌমের অস্পষ্টতা : লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় অঙ্গ রাজ্যগুলো হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম । প্রস্তাবে স্ববিরোধিতা সুস্পষ্ট। স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা বলা হয়। আবার বলা হয় অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম যা লাহোর প্রস্তাবের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়।
৩. শব্দ চয়নে অস্পষ্টতা : লাহোর প্রস্তাবের ধারাগুলোতে অস্পষ্টতা ও স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেমন- (Independent states) স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ এবং (Sovereign) সার্বভৌম যার প্রকৃত অর্থ লাহোর প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা হিসেবে পরিগণিত হয়।
৪. পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে মুসলিম লীগের আইনসভার কনভেনশন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবে বলা হয় একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে। যা লাহোর প্রস্তাবের বিরোধী। জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে States এর স্থলে State শব্দটি গ্রহণ করে যা ছিল এক ধরনের প্রতারণা। জিন্নাহ সুকৌশলে State শব্দটি ব্যবহার করে বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বানচাল করে দেয়।
৫. লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব কি না : লাহোর প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি এবং পাকিস্তান নামের উল্লেখ নেই। কতিপয় হিন্দু সমর্থিত পত্রিকা এবং কংগ্রেস ও হিন্দু সংগঠনগুলো পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে প্রচারণা চালালে এটি দ্রুত পাকিস্তান প্রস্তাব নামে জনপ্রিয়তা পায়। কাজেই লাহোর প্রস্তাবটি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল না অথচ এটি পা কিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিতি পায়। যা লাহোর প্রস্তাবের সীমাবদ্ধতা।
৬. পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমে পাকিস্তান হিসেবে প্রচারণা : লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হলে কংগ্রেস প্রভাবাধীন পত্রিকাগুলোর পাকিস্তান প্রস্তাব শিরোনামে লীগের প্রস্তাবিত দাবি-দাওয়া প্রকাশ করে। গ্রেট ব্রিটেনের পত্র-পত্রিকাগুলোতেও লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব বলে অভিহিত করতে থাকে। ফলে লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং পাকিস্তানের চেতনায় মুসলিম লীগ উদ্ভাসিত হয়।
৭. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মন্তব্য : ১৯৪৩ সালে এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন যে, পাকিস্তান শব্দটি তার বা মুসলিম লীগ কর্তৃক আবিষ্কৃত কোনো শব্দ নয়। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান শব্দটি কিছু ও ব্রিটিশ পত্রপত্রিকার মাধ্যমে পাকিস্তান নামেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি।
জিন্নাহ আরো বলেন যে, কতদিনইবা এত বড় শব্দ ব্যবহার করা যায়। এ জন্য তিনি মাত্র একটি শব্দ প্রস্তাবকে অভিহিত করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। ফলে জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবের মূলনীতি থেকে সরে এসে একটি অখণ্ড স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যান। মূলত জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবকে উপেক্ষিত করে একটি স্বাধীনরাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে অবস্থান নেয়। যা ছিল লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম অস্পষ্টতা।
৮. লাহোর প্রস্তাবের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান : মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাবের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব বলতে একাধিক রাষ্ট্রের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে যে একটি পত্র বিনিময় হয় তাতে জিন্নাহ প্রথম উল্লেখ করেন যে, যে অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি সে অঞ্চলে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হবে। দুই অঞ্চলের প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে কি না জিন্নাহর কাছে গান্ধী এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। এর জবাবে গান্ধীকে তিনি জানান যে প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে না, এগুলো পাকিস্তানের ইউনিট হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক রদ বদল করে এদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে। জিন্নাহ ১৯৪৫ সালের ৮ নভেম্বর এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধিকে বলেন যে, পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে এবং এর প্রদেশগুলো স্বয়ং শাসনের অধিকারী হবে। এর পর ১৯৪৬ সালে মূল লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে স্টেটস (States) শব্দের পরিবর্তে স্টেট (State) শব্দটি ব্যবহার করেন। ফলে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের ধারা বানচাল হয়ে যায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আমি মনে করি লাহোর প্রস্তাবে বেশকিছু অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা ছিল। এর ফলে মুসলীম লীগ ও জিন্নাহ, নিজেদের স্বার্থরক্ষায় একাধিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে একটি অখণ্ড স্বাধীন পাকিস্তান গঠন সম্ভব হয়। দলীয় কোনো নিয়মতান্ত্রিক সমর্থন যেমন ছিল না তেমনি ছিল না নৈতিক ভিত্তি। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় লাহোর প্রস্তাবে ছিল অস্পষ্টতা ও সীমাবদ্ধতা যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছিল।