তর্ক সংগ্রহ অনুসারে কারণতত্ত্ব কী?

অথবা, ন্যায় কার্যকারণতত্ত্ব বলতে কী বুঝ?
অথবা, ন্যায়দর্শনের কার্যকারণ মতবাদ কী?
অথবা, নৈয়ায়িক কারণতত্ত্ব বলতে কী বুঝ?
অথবা, কারণতত্ত্ব বা কার্যকারণতত্ত্ব বলতে ন্যায় দর্শনে কী বুঝানো হয়েছে?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনের আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। ন্যায়দর্শনের মূলভিত্তি হলো ‘ন্যায়সূত্র’। ন্যায়দর্শন যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। ন্যায়দর্শনকে নামান্তরে তর্কশাস্ত্র, প্রমাণশাস্ত্র, হেতুবিদ্যা, বাদবিদ্যা এবং আন্বীক্ষিকী বিদ্যা বলা হয়। ন্যায়দর্শনের অন্যতম প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো কারণতত্ত্ব, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ন্যায় কারণতত্ত্ব অথবা তর্ক সংগ্রহ অনুসারে কারণতত্ত্ব : জগতের যে সকল বস্তু বা ঘটনা উদ্ভূত হয় তাদের প্রত্যেকটির কারণ আছে। বিনা কারণে কোন বস্তু বা ঘটনা উদ্ভূত হতে পারে না। দুটি বস্তু বা ঘটনা যদি এমন সম্বন্ধযুক্ত থাকে যে, একটি অস্তিত্ব অপরটির অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ একটি ঘটলে অপরটি ঘটে, তবে তাদের সম্বন্ধকে
কার্যকারণ সম্বন্ধ বলে। কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ বস্তু বা ঘটনা দুটির পূর্ববর্তীটিকে কারণ বলা হয় এবং পরবর্তিটিকে কার্য বলা হয়। যেমন- মশার কামড়ের পর ম্যালেরিয়া রোগ দেখা দিল। এখানে মশার কামড় হলো কারণ এবং ম্যালেরিয়া রোগ হলো কার্য ।
নৈয়ায়িকদের মতে, “কারণ হলো কার্যের অব্যবহিত, শর্তহীন, অপরিবর্তনীয়, পূর্ববর্তী ঘটনা” (A cause is immediate, unconditional, invariable antecedent to the effect.)। অন্নম ভট্ট বলেন, ‘অসাধারণং কারণং করণম্’। অর্থাৎ কার্যের উৎপত্তিতে যে কারণটি অসাধারণ বা সাধকতম হয় তাকেই কারণ বলা হয়। নৈয়ায়িকদের মতে, কারণরূপ ঘটনা সবসময় কার্যরূপ ঘটনার আগে ঘটবে, যদিও কারণ কার্যের পূর্ববর্তী ঘটনা তবুও যে কোন পূর্ববর্তী ঘটনা কারণ নয়। কারণকে কার্যের অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা হতে হবে। আবার যে কোন অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারণ বলা যায় না, যেমন- দিন-রাত্রির অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা হলেও দিনকে রাত্রির কারণ বলা যায় না। সুতরাং যে অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা শর্তহীন কেবল তাকেই কারণ বলা হয়। নৈয়ায়িকগণ বহুকারণবাদ স্বীকার করেন না। বহুকারণবাদের অনুসারে, একই কার্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে। নৈয়ায়িকগণ বলেন, একই কার্য বিভিন্ন কারণে উৎপন্ন হতে পারে না। তাঁদের মতে, যে কোন একটি বিশেষ কার্যের একটিমাত্র বিশেষ কারণ থাকবে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ন্যায়দর্শন কারণতত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তাঁদের কারণতত্ত্বের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনিক মিল-এর সংগতি লক্ষ্য করা যায়। ‘কারণ হলো সদর্থক ও নঞর্থক শর্তের সমষ্টি’-মিলের এ মতের সঙ্গে ন্যায়দর্শনের কারণতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে।