অথবা, তত্ত্ব গঠনে গবেষণার ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক গবেষক থেকে আরম্ভ করে প্রায় সকল সাধারণ মানুষ ‘তত্ত্ব’ শব্দটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করেন । এ শব্দটি যখন একজন গবেষক ব্যবহার করেন, তখন তিনি কেবল বিশেষ অর্থেই ব্যবহার করেন, আর অন্য সকল মানুষ তা অত্যন্ত সাধারণ অর্থে ব্যবহার করেন। যেমন- বাক্যালাপে প্রায় শোনা যায় যে, ‘আমার থিওরি হলো এটা করা।’ আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, আলাপচারিতার মধ্যে বেরিয়ে আসছে, ‘ কেবল থিওরিটিক্যাল কথাবার্তা বলবেন না ।’ বস্তুত সমাজ জীবনে প্রতিনিয়ত এ থিওরি কথাটি ব্যবহৃত হয় এবং তা অত্যন্ত সাদামাটা অর্থে অর্থাৎ, কখনো ব্যক্তি তার নীতি বুঝানোর জন্য, কখনো অন্য কোন ব্যক্তির আচরণ বুঝানোর জন্য কিংবা কখনো অন্য কোনো দুর্বোধ্য বিষয়কে বিবৃত করার জন্য শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এমন কি সামাজিক বিজ্ঞানেও এর ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক আছে ।
তত্ত্ব গঠনে বা নির্মাণে গবেষণার অবদান : সমাজ গবেষকদের মধ্যে তত্ত্ব সৃষ্টির প্রয়াস সীমিত এবং সামান্য । অধিকাংশ গবেষকের গবেষণা কেবল তথ্য সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ প্রবণতা শুধু এ উপমহাদেশের সমাজ গবেষকদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় তা নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা কানাডার মতো দেশেও পরিলক্ষিত হয়। প্রখ্যাত কানাডীয় সমাজবিজ্ঞানী Don Martindle আশির দশকে Indian Journal of Social Research এ প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তাঁর অধীনে ঐ পর্যন্ত ৮০ জনের অধিক পি এইচ ডি. ডিগ্রী প্রাপ্তদের মধ্যে কেবল প্রতি ৭/৮ জনের মধ্যে একজন প্রকাশের যোগ্য সমাজ গবেষণা পরিচালনা করেন এবং এদের মধ্যে কেবল ৭/৮ জনের মধ্যে একজন তাত্ত্বিক অবদান রাখতে পারেন। সমাজ গবেষণার সাথে তাত্ত্বিক অবদানের সম্পর্ক কি? বস্তুত সমাজ গবেষকরা কিভাবে একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সফলতা লাভের সম্ভাবনা রয়েছে । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণ কি? সমাজ গবেষকরা কিভাবে অধিক তাত্ত্বিক অবদান রাখতে পারেন? সমাজ গবেষণার সাথে তাত্ত্বিক অবদানের সম্পর্ক কি? বস্তুত এর কারণ অনুসন্ধান
করতে গেলে সমাজ গবেষকরা কিভাবে আরো অধিক তাত্ত্বিক অবদান রাখতে পারেন, সে সম্পর্কে আলোচনা করতে হয় ।আর সে আলোচনার জন্যও প্রয়োজন গবেষণার সাথে তাত্ত্বিক অবদানের সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করা।সমাজ গবেষকদের মধ্যে দেখা যায় যে, কেউ হয়ত কোনো তত্ত্ব সম্পূর্ণ মেনে নেন, কেউ সামান্য সংশোধনী দাবি করেন, আবার কেউ বা তার বিপরীত তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। কখনও এমনও দেখা যায় যে, কোন তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান না করে, বরং তার পরিপূরক কোনো নতুন তত্ত্ব বা বিকল্প তৈরি করতে চান। তাই সমাজবিজ্ঞানী ড. খুরশিদ
আলম এর মতে, “সমাজ সম্পর্কিত তত্ত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে মোটামুটি তিনটি নিয়ম লক্ষ করা যায় ।” যথা :
১১. কোনো তত্ত্বের সামান্য পরিবর্তন বা সংশোধন করা (সংশোধিত তত্ত্ব),
২. কোনো তত্ত্বের বিপরীত বা বিকল্প তত্ত্ব তৈরি করা ।
৩. সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করা। এছাড়াও সমাজ সম্পর্কিত তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে আদর্শগত বৈশিষ্ট্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । যেমন—পুঁজিপতিদের সপক্ষে তত্ত্ব সৃষ্টি করা অথবা, সর্বহারাদের পক্ষে তত্ত্ব সৃষ্টি করা। যাহোক, বিভিন্ন সমাজ গবেষক উল্লিখিত তিন নিয়মের যে কোনো একটি বা একাধিক ধারা ব্যবহার করে থাকেন। তাই সমাজ গবেষককে নিরলস পরিশ্রম করতে হয় তত্ত্ব নিয়মের যে কোনো একটি বা একাধিক ধারা ব্যবহার করে থাকেন। তাই সমাজ গবেষককে নিরলস পরিশ্রম করতে হয় তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য । কেননা, পূর্ব হতেই তিনি বলে দিতে পারেন না যে, কোন ধরনের তাত্ত্বিক আবিষ্কার তার পক্ষে সম্ভব । রা। বস্তুত তত্ত্ব সৃষ্টির সাথে সমাজ গবেষণার সম্পর্কটি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে । যেমন-
প্রথমত, প্রথম প্রকারের তত্ত্ব সৃষ্টির ক্ষ
েত্রে বিজ্ঞানী নতুন সমাজ গবেষণা করতে পারেন, নাও করতে পারেন। তিনি বভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তস্যসমূহ থেকেই পুরানো তত্ত্বের পরিবর্তন বা সংশোধন করতে পারেন ।
দ্বিতীয়ত, একইভাবে কোনো সমাজ গবেষক বিদ্যমান কোনো তত্ত্বের বিপরীত বা বিকল্প তত্ত্বও তৈরি করতে পারেন।
তৃতীয়ত, সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্বও সৃষ্টি করতে পারেন। বস্তুত তাকে এক সাথে তিন ধরনের তাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্যই প্রচেষ্টা চালাতে হয় । এতে যে কোন একটি ক্ষেত্রে বা একাধিক ক্ষেত্রে তার সাফল্য আসতে পারে ।
চতুর্থত, আবার কখনো দেখা গেল যে, সমাজ গবেষক কোন একটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং পরবর্তীতে তথ্যগুলোকে সাজানোর পর দেখা গেল যে, একটি নতুন তত্ত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। এ পদ্ধতিতেও তত্ত্ব সৃষ্টি হয়ে থাকে । এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নতুন একটি তত্ত্বের রূপ নিয়েছে সে কথা তিনি অর্থাৎ, তথ্য সংগ্রহকারী সমাজ গবেষক হয়ত খেয়ালই করলেন না এবং পরবর্তীতে অন্য কোনো সমাজ গবেষক সে তথ্য থেকে ঠিকই একটি নতুন তত্ত্ব সৃষ্টি করলেন।সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রচুর ঘটনা লক্ষ করা যায় । প্রকৃতপক্ষে, গবেষণার মাধ্যমেই তত্ত্বের সৃষ্টি হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, তত্ত্ব গঠনের বা তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। যদিও তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই গবেষণার উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়, খেয়াল রাখতে হবে যে তার সংগৃহীত তথ্যে অন্য কোনো তত্ত্বের ইঙ্গিত বা তত্ত্ব বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে কি না। অথবা সংগৃহীত তথ্য অন্য কোনো তত্ত্বকে সংশোধন করে কি না বা বিকল্প বা বিপরীত তত্ত্ব সৃষ্টি করে কি না, কিংবা নতুন কোনো তত্ত্ব সৃষ্টি করেনি । তবে এর জন্য প্রয়োজন সমাজ গবেষকের ব্যাপক তাত্ত্বিক পড়াশোনা ।