অথবা, মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে জি. সি. দেবের দর্শন ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে জি. সি. দেবের দর্শন আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ড. জি. সি. দেব ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট মানবতাবাদী দার্শনিক। দর্শনের তত্ত্বকে তিনি ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করেন। তাঁর কাছে যথার্থ দর্শন মানেই জীবনদর্শন। যে দর্শনের সাথে জীবনের
সম্পর্ক নেই তা নিছক তত্ত্বকথা। জি.সি. দেব তার দর্শনকে সমগ্র মানবতার কল্যাণে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। বাঙালি দর্শনের ইতিহাসে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন।
ড. জি.সি. দেবের মানবতাবাদ : যে মতবাদ মানবকল্যাণের কথা বলে তাই মানবতাবাদ। দর্শনের চিন্তা ভাবনা যখন মানব কল্যাণসাধনের নিমিত্তে কাজ করে তখন তাকে বলা হয় মানবতাবাদী দর্শন। মানবতাবাদ মানুষের কল্যাণের কথা বলে। মানবতাবাদী দর্শনের ইতিহাসে দুই ধরনের মানবতাবাদ দেখা যায় :
১. বস্তুবাদী ধারা
- আধ্যাত্মিক ধারা
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মানবতাবাদ : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব সারা জীবনদর্শন চর্চা করেছেন মানবতার কল্যাণকে সামনে রেখে। মানবতার এই দার্শনিক মতের সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও। তিনি জীবনে কোনোদিন বিবাহ করেননি। তবে তিনি দু’জন দরিদ্র সন্তানকে মানুষ করেছেন, যাদের একজন হিন্দু এবং অপরজন মুসলমান। তারা দু’জনে আবার একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। তিনি তাঁর চাকরি জীবনের শেষের দিকে এসে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক তাঁর পালিত দুই সন্তানকে এবং বাকি তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন, যার৷ সবটুকুই ব্যবহৃত হচ্ছে মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে দর্শন চর্চায়।
বস্তুগত মানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের মধ্যে সমন্বয় : ড. দেব বলেছেন, মানুষের পার্থিব বা জাগতিক
উন্নতির জন্য বস্তুগত মানবতাবাদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা মানুষকে কখনো পরিপূর্ণ কল্যাণ বয়ে
এনে দিতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এ প্রসঙ্গে ড. দেব বলেছেন, “মানবতাবাদ আমরা চাই এবং আমাদের কল্যাণের জন্যই আরো বেশি করে চাই। কিন্তু আমরা শুধু জাগতিক মানবতাবাদ চাই না, সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য জাগতিক মানবতাবাদ নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। কিন্তু তা একদেশদর্শিতায় দুষ্ট এবং আমরা যদি এই
একদেশদর্শি ও চরমপন্থা মেনে নেয়, তাহলে আমরা কুকুরের বাঁকা লেজ আর কখনো সোজা করতে পারব না।” পান্তা ড. দেব বলেছেন, মানবতার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে কখনই অবহেলা করা যাবে না। তিনি বলেছেন, যদি মানবতার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হয়, তবে সে মানবতাবাদ হবে রসহীন মানবতাবাদ, যা কাম্য নয়। তাই তিনি বলেছেন, বস্তুগত মানবতাবাদের সাথে আধ্যাত্মিক মানবতাবাদকে সমন্বয় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “একটি নতুন সমন্বয়ের প্রয়োজন, যে নতুন সমন্বয় বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোর সমাহারে সমন্বয়ী
বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে এবং এখানেই মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় জীবনদর্শন বিদ্যমান।”
ড. দেবের মানবতাবাদী দর্শনে গৌতম বুদ্ধ ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব : ড. দেব তাঁর মানবতাবাদী দর্শন রচনায় প্রাচ্যের অপর দুই বিখ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক গৌতম বুদ্ধ এবং স্বামী বিবেকানন্দের মানবতাবাদী মত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কার ড. দেব স্বামী বিবেকানন্দের মানবতাবাদের প্রশংসা করে বলেছেন, “মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি মুক্তি অর্জনের প্রয়াসকে সঠিক পথে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা ছিল বিবেকানন্দের অপরিসীম প্রচেষ্টা। ব্যক্তি মুক্তি তথা সাধারণ
মানুষের উন্নতির জন্য তাঁর বিশেষ গুরুত্বারোপ ব্যক্তির সর্বোচ্চ পূর্ণতা অর্জন এবং সাধারণ মানুষের চিরকালীন এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তা দূরীকরণের একটি সর্বোচ্চ প্রভাবজনিত প্রচেষ্টা।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব চেয়েছিলেন একটি শোষণ বঞ্চনাহীন বিশ্ব গড়ে তুলতে। তিনি দরিদ্র, অত্যাচারিত, নিপীড়িত দুঃস্থ মানুষকে শোষণ ও জুলুমের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি এমন এক
মানবতাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হবে প্রেম, সহানুভূতি এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সকল মানুষের হৃদয় মন জুড়ে থাকবে অনাবিল শান্তি। তিনি পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে এই ঐক্যের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলেন এবং গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। এ লক্ষ্যে তিনি ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে,
তথা সর্বপ্রকার বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সকল মানুষকে একই মানবতার আদর্শে আনার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন সারাটি জীবন। তাঁর এই প্রচেষ্টার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের উইস বার কলেজে৷ প্রতিষ্ঠিত ‘The Govinda Dev, Foundation for World Brotherhood’ সংগঠনের মাধ্যমে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ড. দেবের অন্যান্য দার্শনিক মতের মতো তাঁর মানবতাবাদের সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গির ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর মানবতাবাদী দর্শনে জাগতিকতাবাদ ও অধ্যাত্মবাদের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধর্মীয় ও অধর্মীয় মানবতাবাদী চিন্তাধারার সমন্বয় করেছেন। সর্বোপরি, ড. দেবের উদ্দেশ্য ছিল
বিশ্বের সকল মানুষকে এক ও অভিন্ন মানবতাবাদী আদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করা। - ০