অথবা, জৈন নিরীশ্বরবাদ ব্যাখ্যা কর। এ মতবাদ স্যাদবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না?
উত্তর৷ ভূমিকা : জৈন দর্শন অতি প্রাচীন দর্শন। জৈনধর্ম ও দর্শনের প্রধান গ্রন্থগুলোতে যেসব উপদেশ ও বাণী আছে সেসব মহাবীরের দান তাই মহাবীরকেই বস্তুত জৈনধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে সকলেই মনে করে। ‘জৈন’ শব্দের উৎপত্তি ‘জিন’ শব্দ হতে। এ ‘জিন’ শব্দের অর্থ হলো ‘জয়ী’। জৈন তীর্থঙ্করগণকে ‘জিন’ নামে অভিহিত করা হয়, কারণ তাঁরা
রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি রিপুগুলোকে জয় করেছিলেন। জৈন দার্শনিকগণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেমন- জ্ঞানতত্ত্ব, পরাতত্ত্ব এবং নীতিশাস্ত্র ও ধর্ম। তাদের ধর্ম সম্পর্কীয় আলোচনায় আমরা ঈশ্বর সম্পর্কিত আলোচনা পাই।
জৈন নিরীশ্বরবাদ : জৈনধর্ম নিরীশ্বরবাদী। বৌদ্ধধর্মের মতো জৈনধর্মও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। জৈনগণ বলেছেন ঈশ্বরের সত্তা, প্রত্যক্ষ অনুমান প্রভৃতির দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। যেসব যুক্তির বলে জৈনগণ নিরীশ্বরবাদের প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছেন সে যুক্তিগুলো নিম্নরূপ :
১. ঈশ্বর প্রত্যক্ষগ্রাহী নন বলে কোন কোন দার্শনিক সম্প্রদায় অনুমানের সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। নৈয়ায়িকগণের যুক্তি হলো, প্রত্যেক সাবয়ব (যার অবয়ব বা অংশ আছে) বস্তু সৃষ্টির জন্য নিমিত্ত কারণ বা কর্তার প্রয়োজন আছে। যেমন- ঘটের জন্য কুম্ভকারের প্রয়োজন। জগৎ সাবয়বী এবং সৃষ্ট। সুতরাং জগতেরও একজন নিমিত্ত কারণ বা কর্তা আছেন এবং তিনিই ঈশ্বর। জৈনগণ বলেছেন, নৈয়ায়িকদের এ অনুমান যুক্তিসিদ্ধ নয়। কারণ জগৎ সাবয়বী কি না এটা প্রমাণ সাপেক্ষ। তাছাড়া সাবয়বী হলে যে জগৎ সৃষ্টি হতে হবে এটারও কোন সঠিক নিয়ম নেই। যেমন- ন্যায়মতে আকাশ সাবয়বী, কিন্তু সৃষ্ট নয়। আকাশ নিত্য দ্রব্য। তাছাড়া যেখানে কোন নিমিত্ত কারণ স্বীকার করা হয় সেখানেই দেখা যায় কর্তা সাবয়বী এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালনার দ্বারা কার্য সৃষ্টি করেন। কিন্তু ঈশ্বরের কোন অবয়ব বা শরীর নেই। সেক্ষেত্রে তিনি কেমন করে জগৎ সৃষ্টি করলেন? কার্যকারণ সার্বিক নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক কার্যের একটি কারণ আছে। সুতরাং জগৎরূপ কার্যেরও একটি কারণ আছে। সে কারণই ঈশ্বর। জৈনগণ বলেছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের পক্ষে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
কারণ প্রত্যেক কার্য কোন একটা কালেই সৃষ্টি হয় এবং সৃষ্টির পূর্বে এটার কোন অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু জগৎ কোন নির্দিষ্ট কালে সৃষ্টি হয় নি। এটা অনাদি কাল থেকে চলে আসছে। সুতরাং জগতের কারণরূপী ঈশ্বরের ধারণা নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয় । কার্যকারণ বিধি পরিবর্তনকে স্বীকার করে। এ বিধি অনুসারে কারণের পরিবর্তন ছাড়া কার্য সৃষ্টি হয় না।
আবার প্রত্যেক পরিবর্তনেরও কারণ আছে। সুতরাং ঈশ্বর যদি জগতের কারণ হন, তাহলে ঈশ্বরেরও পরিবর্তন আছে এবং তার কারণও আছে। জৈনরা বলেছেন, এভাবে জগতের কারণ খুঁজতে গেলে অনবস্থা দোষ ঘটে। কারণ জগৎ স্রষ্টারূপী ঈশ্বরের ধারণা যথার্থ নয়। জৈনগণ বলেছেন, ঈশ্বরকে পূর্ণ বলা হয়। তাই তাঁর অভাব থাকতে পারে না। অভাব পূরণের জন্যই কার্যের সৃষ্টি। সুতরাং অভাবহীন ঈশ্বর জগতের স্রষ্টা হতে পারে না। তিনি খেয়াল খুশিমতো জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না। কারণ তা হলে জগতে নিয়ম শৃঙ্খলা দেখা যেত না। কোন নীতি অনুসারেও ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না। কেননা তিনি তখন নীতির অধীন হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর স্বাধীনতা নষ্ট হয়। দয়াবশত তিনি জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না। কারণ তা হলে জগতে দুঃখ দেখা দিত না। সুতরাং জৈন মতে ঈশ্বর জগৎ স্রষ্টা নন। জৈনগণ বলেছেন, ঈশ্বরের যেসব গুণ আরোপ করা হয়, সেগুলোকে প্রমাণ বলা যায় না। যেমন- ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলা হয়। যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হন, তবে জগতের সব বস্তুই তিনি নির্মাণ করতে পারেন। কিন্তু
বাস্তবে তা দেখা যায় না। ঈশ্বরকে আবার নিত্যমুক্ত ও নিত্যপূর্ণ বলা হয়। জৈনগণ বলেছেন, নিত্যমুক্ত ও নিত্যপূর্ণ সবগুলো অর্থহীন। কারণ মুক্তির আগে বন্ধন, পূর্ণতার আগে অপূর্ণতা থাকবেই। মুক্ত বললে আমাদের বুঝতে হবে বন্ধন থেকে মুক্ত, তেমনি পূর্ণ বললে আমাদের বুঝতে হবে অপূর্ণ থেকে পূর্ণ। সেক্ষেত্রে ঈশ্বর নিত্যমুক্ত এবং নিত্যপূর্ণ কেমন করে হতে পারে? ঈশ্বরকে এক এবং অদ্বিতীয় বলা হয়, যেহেতু একাধিক ঈশ্বর থাকলে মতভেদের দরুন জগতের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। জৈন মতে, এ যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আমরা প্রায়ই দেখি বহু রাজমিস্ত্রি মিলে প্রাসাদ নির্মাণ করে এবং বহু মৌমাছি মিলে সুন্দর মৌচাক তৈরি করে। এমতাবস্থায় বহু ঈশ্বর থাকলে জগতে বিশৃঙ্খলা দেখাদিবে এ কথা লোকে মানবে কেন? জৈন নিরীশ্বরবাদ কি স্যাদবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ : জৈনদের মতে, বস্তুর অসংখ্য গুণ আছে। সাধারণ মানুষ তার সীমিত জ্ঞান দ্বারা সব গুণকে জানতে পারে না। একমাত্র তীর্থঙ্কররা যারা কেবল জ্ঞানের অধিকারী তারাই সব গুণকে জানতে পারে। কোন একটি বস্তুর অসংখ্য গুণ ধর্মের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ বা ধর্ম সম্পর্কে আংশিক জ্ঞানকেই জৈনরা নয় বা অবধারণ বলেছেন। তাই জৈনরা কোন বস্তু সম্পর্কে কোন অবধারণ প্রকাশ করার সময় তাকে শর্তহীন না করে শর্তসহ করা উচিত বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, প্রতিটি অবধারণকে অবকাশ করার সময় ‘স্যাৎ’ অর্থাৎ ‘সম্ভবত’ এ বিশেষণ যোগ করা উচিত। প্রতিটি অবধারণে যদি ‘স্যাৎ’ শব্দটি থাকে তাহলে বুঝা যাবে যে, অবধারণটি আংশিক সত্য
ও আলোচ্য বস্তু সম্পর্কে বিকল্প অবধারণও সত্য। জৈনদের এ মতবাদের নাম ‘স্যাদবাদ’ । স্যাদবাদ অনুযায়ী আমাদের মত অপূর্ণ মানুষ বস্তু সম্পর্কে যেসব ‘নয়’ বা পরামর্শ রচনা করে তা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বস্তুটিকে দেখা হয়েছে, সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বস্তুটির এক বিশেষ দিক সম্বন্ধে সত্য। স্যাদবাদের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব জৈনদর্শনকে উদার মতাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। জৈনরা অন্যান্য দর্শনের মতবাদকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিশ্বের সম্ভাব্য আংশিক সত্য ব্যাখ্যা বলে বিশ্বাস করে। অন্যান্য দর্শনের গোঁড়ামি জৈনরা সহ্য করতে নারাজ। তাই জৈন নিরীশ্বরবাদ স্যাদবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ভারতীয় দর্শনে জৈন নিরীশ্বরবাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। জৈনগণ নানাবিধ যুক্তির সাহায্যে ঈশ্বরবাদ খণ্ডন করে তাদের নিরীশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু জগৎ স্রষ্টা ঈশ্বরের সত্তা অস্বীকার করলেও মুক্তসিদ্ধ পুরুষের ধ্যান ও পূজার প্রয়োজনীয়তা জৈনগণ স্বীকার করেন। সুতরাং জৈনধর্ম মতে, মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষের মধ্যেই ঐশ্বরিক গুণাবলি বিদ্যমান।