জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘বনলতা সেন’ কবিতার মূলবক্তব্য তোমার নিজের ভাষায় লিখ।

উত্তর : ‘বনলতা সেন’ কবি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) তথা বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা। এ কবিতার প্রেম ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এর প্রেম শাশ্বত নরনারীর চিরন্তন প্রেম। মহাকাব্যের ব্যাপ্তি ধারণকারী এ আশ্চর্য গীতি কবিতাটির মর্মে রয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেমের অনুভব। শাশ্বতকালের প্রেম-পিপাসা প্রশান্তির স্নিগ্ধ স্পর্শে এখানে হয়ে উঠেছে মহিমাময়। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় কবি শাশ্বত সেই প্রেমকে প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনের কানায় কানায়। প্রেমের আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। প্রেমের সন্ধানে মানুষ সংসার ছাড়ে, অনিশ্চিত পথের যাত্রী হয় এবং প্রয়োজনে আপন জীবন উৎসর্গ করে। প্রেমহীন জীবন মানুষের কাছে রুক্ষ মরুভূমির মতো। অনাদিকাল থেকে মানুষ প্রেমের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশে অভ্যস্ত। প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষ তার ক্লান্তির অবসান ঘটাতে চায় প্রেমিকার বাহুবন্ধনের আশ্রয়ে। মানুষ তার সারা দিনের তথ্য সারাজীবনের ক্লান্তি দূর করতে কাঙ্ক্ষিত নারীর সান্নিধ্য কামনা করে। পুরুষের জীবন সমুদ্র সহস্র তরঙ্গের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়। সফেন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে একটুখানি নীড়ের আশ্রয় আর নিবিড় শান্তি তার একান্ত কাম্য হয়ে উঠে। এ প্রেমিক সত্ত্বা চিরন্তন। কাল থেকে কালান্তরে যুগ থেকে যুগাভরে এ সত্তা সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ যে প্রেমানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা কেবল কোন একজন মানুষের ব্যক্তি অনুভূতির প্রকাশ নয়। কবির অনুভূতি সমগ্র পুরুষজাতির অনুভূতিকে ব্যক্ত করে তুলেছে। শ্রমক্লান্ত মানুষ (পুরুষ) চিরকালই শাস্তির অন্বেষণ করে চলেছে। এই কাঙ্ক্ষিত শাস্তির জন্য সে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ফেরে। কিন্তু শান্তি ধরা দিতে চায় না। কবি এ কবিতায় এক শাশ্বত নারীর সন্ধান পেয়ে তার স্তুতি রচনা করেছেন। তিনি বলেছেন-


“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”


জাহাজের হালভাঙা দিশেহারা নাবিক যেমন সমুদ্রের বুকে সবুজ ঘাসে ভরা দারুচিনি দ্বীপ দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হয়; তেমনি শ্রমক্লান্ত কবির আত্মা নাটোরে এসে বনলতা সেনকে দেখতে পেয়ে তার কাঙ্ক্ষিত নীড়ের সন্ধান পান। এই কথাটাকে কৰি চমৎকারভাবে বর্ণনা করে বলেছেন-


“অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে,
বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”


আলোচ্য কবিতার বনলতা সেন চিরকালের প্রেমময়ী নারীর এক আশ্চর্য মনোহর প্রতিমা। প্রাণের অকৃপণ ঐশ্বর্যে সে সমৃদ্ধ। তাই মুহূর্তেই সে সঞ্জীবিত করে তোলে হাজার বছরের ক্লান্তিতে জরজর পুরুষ সত্তাকে। যে প্রেমময়ী নারীর সন্ধানে পুরুষ অনায়াসে অতিক্রম করে ইতিহাস আর ভূগোলের বিস্তীর্ণ চড়াই উৎরাই, ছুটে চলে দেশ থেকে দেশান্তরে, অজানা থেকে আর এক অজানায়, বনলতা সেন সেই শাশ্বত নারীর সবখানি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ধারণ করে আছে তার দেহ ও মনে। তাকে পেয়ে কবি তৃপ্তিবোধ করেছেন। তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সেই অনাস্বাদিত প্রেমের ফুরণ। তাকে তিনি গ্রহণ করেছেন একান্ত আপন করে। তাঁর সমস্ত জীবনের ক্লান্তি এ নারী ধুয়ে মুছে ফেলে পরিপূর্ণতা দান করেছে। এ নারী কল্যাণময়ী শাশ্বত নারী। প্রেমের শাশ্বত অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছে আলোচ্য কবিতাটি। এখানে প্রেম চেতনার সাথে চমৎকারভাবে একাকার হয়ে গিয়েছে প্রকৃতি চেতনা। প্রেম ও প্রকৃতি এখানে যেন পরস্পরের পরিপূরক। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে না এলে সে প্রেম পরিপূর্ণ হতে পারে না, কবি জীবনানন্দ দাশ অনেকটা নতুনভাবেই তা আমাদের শিখিয়েছেন। উপমা আহরণ করেছেন তিনি প্রকৃতি থেকে, প্রশান্তি ও পূর্ণতার জন্য তিনি বার বার ফিরে তাকিয়েছেন প্রকৃতির দিকে, সাথে সাথে প্রকৃতিকে নতুনভাবে দেখবার চোখ খুলে দিয়েছেন তাঁর পাঠকদের। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কবি মৃত্যুহীন মানব সত্তার অন্তর্লোককে উজ্জীবিত করা মহিমাময়ী প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। অনন্ত কাল ধরে টিকে থাকা পৃথিবী তার ছোট ছোট পিঞ্জরে আমাদের জীবনকে লালন করে আসছে। ব্যক্তি সত্তার সকল খেলার সীমা সেই নির্দিষ্ট পিঞ্জরে আবদ্ধ। তাই জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী খেলাটুকু শেষ করে ব্যক্তি এক সময় মৃত্যুতে লীন হয়ে যায়। কিন্তু লীন হয় না মানবসত্তা ও সভ্যতা। সেই মৃত্যুহীন মানবসত্তার অনুভব বুকে নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে কবি বিচরণ করেছেন পৃথিবীর অলিতে গলিতে। ইতিহাস-ভূগোলের সীমারেখার মধ্য থেকেই তিনি পেয়ে গিয়েছেন তাঁর প্রার্থিত নারী সত্তাকে। তার রূপ ও গুণের কাব্যিক বর্ণনায় মুখরিত করেছেন কবিতাটিকে। ‘বনলতা সেন’ প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অনুপম কবিতা। যুগ যুগান্তরের পথবাসী পুরুষসত্তা এখানে খুঁজে পেয়েছে শাশ্বত নারী সত্তাকে। প্রেম ও সৌন্দর্যের অনিঃশেষ দীপ্তিতে মহীয়ান হয়ে উঠেছে সেই কাঙ্ক্ষিত শাশ্বত নারী। তাকে পাওয়া যে কোন পুরুষের সৌভাগ্যের বিষয়। কবি সেই সৌভাগ্যের অধিকারী এক প্রেমিক পুরুষ। নাজ তির্জিক

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a4%e0%a6%be-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a7%8d/