জাতীর স্বাস্থ্যনীতি ২০০০ সম্পর্কে লিখ।

উত্তর ঃ ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি। স্বাস্থ্যসেবাকে প্রতিটি নাগরিকের নাগালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো এ নীতির মূল লক্ষ্য। এ নীতির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাস্থ্যখাতে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নীতিমালা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা পূরণে সার্বিক সুস্থতা সুস্থ
প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্নিহিত মূলনীতি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন প্রতিষ্ঠা করা। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর পরিচর্যার ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা নিশ্চিতকরণের মূলনীতি অনুসরণ করা। সর্বস্তরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণ ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির লক্ষ্যে হবে ব্যক্তি তথা ক্লায়েন্ট-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, যেন যার যা চাহিদা সেই মতো সেবা বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় ।
→ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য: সমাজের সবৃত্তরের মানুষের কাছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) (অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার মৌলিক উপকরণ পৌঁছে দেয়া এবং অনুচ্ছেদ ১৮ (১) (জনগণের পুষ্টির স্থর উন্নয়ন ও
জনস্বাস্থ্যর উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে) অনুযায়ী জনগণের পুষ্টির উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করা।
২. জন সাধারণ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উপায় উদ্ভাবন করা।
৩. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি চাহিদা ব্যবস্থার মান গ্রহণযোগ্যতা সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।
৪. জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে শিশু ও মায়েদের অপুষ্টি হার হ্রাস করা এবং সকল শ্রেণির মানুষের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ও সমন্বিত কর্মসূচি প্রদান করা।
৫. দেশে বর্তমান শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার হ্রাস করে আগামী পাঁচ বছরে এ হারকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে সীমিত করার যথোপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা।
৬. ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মা ও শিশু স্বাস্থ্যর উন্নীতর জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন সন্তান প্রসব সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা করা।
৭. প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন করা।
৮. প্রতিটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সহযোগী কর্মকর্তা/কর্মচারীর উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধপত্রের সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
৯. অতি দরিদ্র ও অতি অল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য সহজলভ্য
ও কার্যকর করার পন্থা উদ্ভাবন করা।
১০. মানসিক প্রতিবন্ধী ও শারীরিক বিকলাঙ্গদের সাথে সাথে বয়োবৃদ্ধদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা।
→ মূলনীতি ঃ
১. বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিককে জাতি, ধর্ম গোত্র আয় পুরুষ মহিলা বিশেষ করে শিশু ও নারী ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের সাংবিধানিক অধিকতর নিশ্চিত করে সামাজিক ন্যায় বিচার ও সমতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ভোগ করতে প্রচার মাধ্যমের সহায়তা সচেতন ও সক্ষম করে তোলা।
২. প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অত্যাবশ্যক সেবাগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডের যে-কোনো ভৌগোলিক অবস্থানের
প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌছে দেয়া ।
৩. অধিক গুরুত্বসম্পন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের সুবিধাবঞ্চিত গরি ব ও বেকারত্ব পীড়িত জনগণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার লক্ষ্যে বিরাজমান সম্পদের সমবণ্টন ও সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৪. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে ও জনগণের দায়িত্ব ও অধিকতর প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় তহবিল গঠনে, মনিটরিং এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান পদ্ধতি পর্যালোচনা ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা।
৫. সবার জন্য কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ সমন্বিত প্রয়াসের সুযোগ সৃষ্টি ও সহযোগিতা প্রদান ।
৬. পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সমন্বিত, সম্প্রসারণ ও জোরদার করার মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।
৭. স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্যর সেবাগুলোকে আরো জোরদার এবং সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে কার্যকর ফলপ্রসূ ও সুদক্ষ প্রযুক্তি গ্রহণ ও যথাযথ ব্যবহার, পদ্ধতি উন্নয়ন ও গবেষণা কর্মকে উৎসাহিত করা।
→ কর্মকৌশলঃ
১. স্বাস্থ্যনীতির সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের জন্য রাজনৈতিক সমর্থনসহ সকলের সম্মতি ও সদিচ্ছা প্রয়োজন যা আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন সাধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
২. ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ এ মৌলিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যয় সাশ্রয়ী বা cost effective উপায়ে অধিক জনগণকে সর্বোত্তম স্বাস্থ্য সূবিধা প্রদান করা । আরোগ্যমূলক ও পুনর্বাসন সেবাগুলোর সন্তোষজনক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
৩. যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা সর্বজনীনভাবে গৃহীত, সেহেতু এ পদ্ধতিতে ব্যাপক এবং ব্যয় সাশ্রয়ী বা cost-effective স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে মূল উপাদান হিসেবে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে গ্রহণ করা হবে।
৪. রোগ ব্যাধির বিস্তৃতির গতিবিধি ঘনিষ্ঠ নজরদান (Epidemiological Survcillance) পদ্ধতিকে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মসূচির সাথে সমন্বয় সাধন করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে (Epidemiological
Surveillance) এর মূল দায়িত্ব দিতে হবে।
৫. সর্বস্তরে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণ ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা হবে।
৬. প্রয়োজনের ভিত্তিতে (Need-based) চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরো গণমুখী এবং যুগোপযোগী করতে হবে।
৭. ডাক্তারদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক বিষয়ের উপর যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. শহর ও গ্রামীণ সেবার বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে অবকাঠামোগত ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্মীদের তাদের কর্মস্থলে উপস্থিতি ও সর্বোত্তম সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে।
৯. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে সকল উন্নয়ন কার্যক্রমে একটি সেক্টর ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রচলিত হবে।
→ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির গুরুত্ব :
১. সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা : দেশের জনগণের জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত উপায় উদ্ভাবন করা স্বাস্থ্যনীতির একটি অন্যতম দিক। এর ফলে সকলেই স্বাস্থ্য সুবিধা পাবে।
২. সরকারি চিকিৎসা মানের উন্নয়ন : প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থারমান গ্রহণযোগ্যতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
৩. কার্যকর পুষ্টি কর্মসূচি গ্রহণ ঃ জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে শিশু ও মায়েদের অপুষ্টির হার হ্রাস করা এবং
সকল শ্রেণির মানুষের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ও সমন্বিত কর্মসূচি প্রদান করা। এর ফলে পুষ্টিহীনতা থেকে জনগণ রক্ষা পাবে।
৪. শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুহার হ্রাস ঃ স্বাস্থ্যনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দেশে বিদ্যমান বর্তমান শিশু ও মাতৃ- মৃত্যুর হার হ্রাস করে আগামী পাঁচ বছর এ হারকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে সীমিত করার জন্য যথোপযুক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা।
৫. হাসপাতালে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ : প্রতিটি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৬. প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঃ প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুযোসুবিধা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন করার নিমিত্তে স্বাস্থ্যনীতির গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা স্বাস্থ্য নীতিতে এ সম্পর্কিত ধারণা পাওয়া যায়।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের স্বাস্থ্যনীতির বিভিন্ন ধারায় তাকালে দেখা যায় যে, এ দেশের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। এর ফলে দেশের স্বাস্থ্যখাত ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নয়ন ঘটবে এবং সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।