অথবা, জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কীরূপ? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সর্বোচ আসনে রাষ্ট্রপতির অধিষ্ঠান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মধ্যমণি হল রাষ্ট্রপতি। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের শাসন সংক্রান্ত সকল কর্তৃত্ব তার হাতে ন্যস্ত। এছাড়াও তিনি আইন প্রণয়ন ও বিচার’ সংক্রান্ত কাজেও প্রভাব বিস্তার করেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের মুখপাত্র, সম্মান ও মর্যাদার কেন্দ্রস্থল। তিনি জাতীয় নেতাও বটে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে C. F. Strong বলেছেন, “বর্তমান কালে পৃথিবীতে কোন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মত ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা দেখা যায় না।”
জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিম্নে জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা আলোচনা করা হল:
১. প্রধান প্রশাসক হিসেবে ভূমিকা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি মার্কিন শাসনব্যবস্থার প্রধান প্রশাসক। এজন্য মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। শাসন বিভাগ সম্পর্কিত সকল নীতি প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োগের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে প্রশাসনিক এজেন্সিসমূহের কাজের তদারকি, প্রশাসনিক কাঠামোর বিন্যাস সাধন, শাসন বিভাগীয় আদেশ জারি, বিভিন্ন বিভাগের কাজের সমন্বয় সাধন প্রভৃতি সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। এছাড়া কংগ্রেস প্রণীত আইন যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের রায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রভৃতি যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে কি না
জাতীয় নেতা হিসেবে তা লক্ষ্য করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির।
২. রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে ভূমিকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তিনি জাতীয় নেতৃত্ব দান করেন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে। আর নীতিনির্ধারণ ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন সরকার প্রধান হিসেবে।
৩. আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা: জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। যদিও সংবিধান কংগ্রেসকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছেন তথাপি মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে বাণী প্রেরণ, কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান, ভেটো প্রয়োগ, জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ ইত্যাদি উপায় অবলম্বন করে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন।
৪. নিয়োগ সংক্রান্ত ভূমিকা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগ ও পদচ্যুত করতে পারেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারক, কূটনৈতিক দূত, কেবিনেটের সদস্য, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের নিয়োগ করতে পারেন। সুতরাং জাতীয় নেতা হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৫. সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ভূমিকা: সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও স্বদেশরক্ষী বাহিনীর সর্বপ্রধান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, “The president shall commander in chief of Army, Navy of U.S.A.” সিনেটের অনুমোদনসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর অফিসারদের নিয়োগ করতে পারেন এবং প্রয়োজন মনে করলে যুদ্ধের সময় তাদের পদচ্যুত করতে পারেন। সেনাবাহিনী গঠন, বিদেশে সৈন্য প্রেরণ, কোন দেশ আক্রমণ করা প্রভৃতি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার আওতাভুক্ত।
৬. চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে ভূমিকা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবিধান অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে কোন চুক্তি কার্যকর করতে হলে সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। অবশ্য সিনেটের অনুমোদনের ঝামেলা এড়াবার জন্য রাষ্ট্রপতি প্রশাসনিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের জন্য সিনেটের সম্মতির প্রয়োজন হয় না।
৭. জরুরি অবস্থাকালীন ভূমিকা: সাংবিধানিকভাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির উপর জরুরি অবস্থা ও সংকটকালে জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তায়। দেশের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির এক্তিয়ার ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। এরূপ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করেন।
৮. যুদ্ধকালীন সময়ে বিশেষ ভূমিকা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি সৈন্য প্রেরণ, যুদ্ধ প্রণালী, অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে একক ক্ষমতার অধিকারী। কংগ্রেসের অনুমোদনসাপেক্ষে যুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি অধিকৃত যে কোন অঞ্চলে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি যুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৯. বিশেষ অধিবেশন আহ্বানের ক্ষেত্রে ভূমিকা: জরুরি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন বা ‘Extra ordinary session’ আহবান করতে পারেন। মার্কিন জনমতকে রাষ্ট্রপতির সপক্ষে প্রভাবিত করতে পারলে কিংবা কংগ্রেসে রাষ্ট্রপতির দলের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিজের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারেন।
১০. ভেটো প্রয়োগের ক্ষেত্রে: রাষ্ট্রপতির সম্মতি ব্যতীত কংগ্রেস অনুমোদিত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। কংগ্রেস কর্তৃক অনুমোদিত কোন বিল রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণের পর তিনি তিন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। যথা:
(১) রাষ্ট্রপতি বিলের স্বাক্ষর দিতে পারেন, (২) Veto দিতে পারেন এবং
(৩) Pocket veto এর মাধ্যমে আটকে রাখতে পারেন।
এভাবে কংগ্রেসের আইন প্রণয়নের কার্যকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি Veto প্রয়োগের মাধ্যমে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারেন।
১১. অর্থ সংক্রান্ত ভূমিকা: অর্থ সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। রাষ্ট্রপতিকে সারা বছরের জন্য আনুমানিক আয়ব্যয়ের একটি হিসাব কংগ্রেসের নিকট পেশ করতে হয়। Budget Bureau -এর সহায়তায় বাজেট ও হিসাবরক্ষণ আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিভাগের আনুমানিক ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস, বৃদ্ধি বা সংশোধন করতে পারেন।
১২. কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূমিকা: কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্যদের সাথে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ভেটো প্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন প্রভৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতীয় নেতা হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের তুলনায় তিনি শুধু একজন দক্ষ জাতীয় নেতাই নন, বরং সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী শাসনকর্তাও। বস্তুত একজন দক্ষ, যোগ্য ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হলে এবং সমকালীন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং যথেষ্ট মর্যাদা ভোগ করবেন তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।