উত্তর। ভূমিকা ঃ বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন করেছেন। এসব নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নে কতটুকু অর্থপূর্ণ উন্নয়ন সাধন করবে তা রিচার্য বিষয়। এ নীতিগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা নীতি, যুব উন্নয়ন নীতি, শিশু কল্যাণ নীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, শিক্ষা নীতি
উল্লেখযোগ্য। এ নীতিগুলোর বিশেষত্ব হলো সংশ্লিষ্ট সমস্যা দূর করা এবং সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
→ জনসংখ্যা নীতি ঃ সকল নাগরিকের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম অঙ্গীকার। সংবিধানের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজন তথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, ও বাসস্থান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের মানুষের এ সকল সংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন
নীতিমালা গ্রহণ করেছেন। এ নীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই সরকার ১৯৭৬ সালে জনসংখ্যা নীতির একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে এবং জনসংখ্যা সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ নীতি সরকারের সবচেয়ে সফল নীতিসমূহের মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যা নীতির রূপরেখায় মা ও শিশু স্বাস্থ্য,
পরিবার কল্যাণ এবং উন্নত জীবনমান। নিশ্চিত করার প্রয়াসে পরিবারের আকার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে সার্বিক সমাজের পুনর্গঠন ও জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। এ রূপরেখায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং তদারিকা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। গৃহীত কর্মসূচি গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পছন্দ অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম জোরদার করা, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে যুব ও নারী সমাজ, ধর্মীর গোষ্ঠী ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সম্পৃক্ত করা, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা এবং গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উন্নয়ন সাধন করা। এতে আইনগত ব্যবস্থার আওতায় বিয়ের বয়স বৃদ্ধি করা এবং মৌলিক তথ্য নিবন্ধন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রতি ও জোর দেয়া হয়।
বাংলাদেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতার এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে এই নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বুখারেস্ট এবং এরপর ১৯৮৪ সালে মেক্সিকো সিটিতে বিশ্ব জনসংখ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনগুলোর সুপারিশের আলোকে বাংলাদেশের কর্মকৌশল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে কায়রোতে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিং এ বিশ্ব নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনগুলোর এবং
পরবর্তীতে International Conference on Population and Development = ICPD + S এবং বেইজিং +S সম্মেলনের সুপারিশমালার উন্নত প্রজনন স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান, শিক্ষা সুবিধা এবং প্রজনন অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহিলাদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক জনমিতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সুপারিশসমূহ বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়।
→ বাংলাদেশের জনসংখ্যার পরিস্থিতি ঃ নিম্নে জাতীয় জনসংখ্যা নীতির আলোকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার বর্তমান পরিস্থিতি আলোচনা করা হলো :
১. জনমিতিক ঃ বর্তমানে (২০০০) বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১২.৯ কোটি ( পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পন
া ) ও বৃদ্ধির হার
১.৫ শতাংশ। প্রতি হাজারে স্থূল জন্মহার ২৪ ও স্থূল মৃত্যুহার ৮। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩% শহরে বাস করে । মহিলা প্রতি গড় সন্তান সংখ্যা ৩.৩ (মোট প্রজনন হার)। ২০০৫ সালে বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩.৮ কোটি ও প্রজননক্ষম মহিলার সংখ্যা ৪ কোটিতে দাঁড়াবে। স্থূল জন্মহার কমে ১৯ হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩২ শতাংশে
নেমে আসতে পারে। পুরুষ ও মহিলার আয়ুকাল যথাক্রমে ৬২.১ ও ৬১.৮ হবে।
২. প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা : বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য হলো মাতৃ মৃত্যুহার ২০১৫ সালের মধ্যে ৩.০ তে কমিয়ে আনা। বিবাহিত দম্পতিদের ৫৩.৮ ভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ২.২ লক্ষ্য মাত্রা
অর্জনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
৩. জনসংখ্যার উন্নয়ন ঃ জনসংখ্যার আকার ও বিন্যাস উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও ফলাফলকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জনসংখ্যা রোধে প্রভাবিত করে। এজন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মসূচিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এতে বিয়ের বয়স, সন্তান গ্রহণে বিরতি ও Population momentum এর গতি শ্লথ হবে।
→ কতিপয় জনসংখ্যা উদ্ভূত সমস্যা : জনসংখ্যা নীতির সম্পূরক রূপে এসব সমস্যা সমাধান ও কিশোর কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের জন্য সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করতে হবে।
১. কিশোরীর ও কিশোর স্বাস্থ্য : দেশের ২৩% জনগোষ্ঠী ১০-১৯ বছর সীমার মধ্যে ও ১৮% সন্তানের জন্ম দেয় ১৫-১৯ বছরের মেয়েরা। সুতরাং কিশোরীদের স্বাস্থ্য, নিরাপদ প্রসব, যৌনব্যাধি ও প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজন ।
২. পুষ্টিহীনতা ঃ দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের পুষ্টির পরিমাণ ১৭০০ কিলো ক্যালরি বা তার নিচে, জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নে মাথাপিছু খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
৩. আর্সেনিক দূষিত পানি ঃ দেশে আর্সেনিক মাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নিরাপদ ও পানির প্রয়োজন মেটাতে যথাযথ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা প্রণয়নের পাশাপাশি ব্যবহারে সচেতনতার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায় যে, এমতাবস্থায় জাতির সামনে ২০০৫ সালে এন. আর. আর-১ অর্জনে জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যমান পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারীর হার ৫১ হতে ২০০৫ সালে ৬৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। জনসংখ্যা নীতির আওতায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণ কররে ২০২০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ১৭২ মিলিয়নের স্থলে ১৬২ মিলিয়ন করা সম্ভব হবে।