জন্মাদ্যস্য যতঃ”-এ উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ব্রহ্মসূত্রের দ্বিতীয় সূত্র ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ব্রহ্মসূত্রের যে কোন একটি সূত্র আলোচনা কর।
অথবা, “জন্মাদ্যস্য যতঃ” ব্রহ্মসূত্রটি সম্পর্কে কি জান?
অথবা, “জন্মাদ্যস্য যতঃ” বলতে কী বুঝ?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনে আস্তিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বেদান্ত দর্শন অত্যন্ত প্রাচীন। মহর্ষি বাদরায়ন বেদান্ত দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রহ্মসূত্র এবং এটির ভাষ্যসমূহে ভারতীয় প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতামত উল্লেখ করা হয়। ব্রহ্মসূত্রে সমন্বয়, অবিরোধ, সাধন ও ফল নামক মোট চারটি অধ্যায়ে সর্বমোট ৫৫৫টি সূত্র রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্ম সম্পর্কে বিভিন্ন বেদবাক্যের তাৎপর্যের সমন্বয় করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিরোধী মতের আলোচনা ও নিরাকরণ করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে কোন উপায়ে ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করা যায় তার আলোচনা রয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ব্রহ্মবিদ্যার
ফলাফল আলোচিত হয়েছে। ব্রহ্মসূত্রের প্রতিটি অধ্যায় আবার চারটি পদে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রত্যেকটি পদে আবার কতকগুলো অধিকরণের সমষ্টি। প্রত্যেকটি অধিকরণ আবার কতকগুলো সূত্র নিয়ে গঠিত।
দ্বিতীয় সূত্র : জন্মাদ্যস্য যতঃ জন্মাদি + (সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়) + অসৎ + (এ জগতের) যতঃ (যা থেকে)। প্রথম সূত্রের .যে জিজ্ঞাসীত ব্রহ্ম-তাঁর লক্ষণ সম্বন্ধে সূত্রকার দ্বিতীয় সূত্রে বলেছেন, যা থেকে এ জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় হয় তিনিই ব্রহ্ম। এ সূত্র থেকে বুঝা যায় যে, সৃষ্টির যত নাম, যত রূপ এবং যত আকার প্রকাশমান তা সবই ব্রহ্ম। ব্রহ্ম থেকেই সৃষ্টি, ব্রহ্মেই স্থিতি এবং ব্রহ্মেই প্রলয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম কেবল সৃষ্টির কারণই নন পরন্তু তিনি এ জগতের স্থিতি এবং প্রলয়েরও কারণ। এ থেকে ব্রহ্মের সর্বজ্ঞতা সম্পর্কে সন্দেহ নেই। ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ বলেই তাঁর থেকে এ জগতের সৃষ্টি হয় এবং স্থিতি ও প্রলয়কাল নির্দিষ্ট হয়। এ থেকে ব্রহ্মের কর্তৃত্ব এবং ভোক্তৃত্ব দুই-ই এতে প্রমাণিত হচ্ছে। সূত্রটিতে জন্মাদি শব্দ থাকায় সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় এ তিন অবস্থাই ব্রহ্মে অনুসৃত হয়। ব্রহ্ম সৃষ্টির উপাদান। সৃষ্টি লীন হয় ব্রহ্মে। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোন কিছু এ জগতের নির্মিত্ত ও উপাদান-কারণ হতে পারে না। সর্বজ্ঞতার সাথে সর্বশক্তি সত্তা ও ব্রহ্মে সূচিত হয় এবং তিনি যেহেতু সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কর্তা সেহেতু তিনি নিরতিশয়। অতএব ব্রহ্ম এক, অদ্বৈত, সর্বব্যাপী, অনন্ত, শুদ্ধ, মুক্ত এবং চৈতন্যময়। তিনি জগদ্ব্যাপী, জগন্মূর্তি এবং জগদতীত । শ্রুতি ছাড়া অন্য েকোন প্রমাণ দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায় না। তাই ব্রহ্ম সম্পূর্ণ নিত্য।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রহ্মের প্রথম লক্ষণ হলো তিনি সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের উপাদান ও নিমিত্ত- কারণ । দ্বিতীয় লক্ষণ ব্রহ্ম থেকেই শাস্ত্রের উৎপত্তি বলে ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ। সৃষ্টাদি ও শাস্ত্রাদির আকারগত ও অর্থগত পার্থক্যের মূলে রয়েছে ব্রহ্মের একাংশের অভিব্যক্তি। শঙ্করাচার্য সৃষ্টিকে মায়া এবং শাস্ত্রকে অবিদ্যা আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু জগৎ ও শাস্ত্র অপূর্ণ হলেও ব্রহ্মেই এরা অন্বিত হচ্ছে। এজন্যই দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রের পর চতুর্থ সূত্রের উপস্থাপন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তাই এ কারণেই বাদরায়ন প্রথম সূত্রের পর দ্বিতীয় সূত্র, দ্বিতীয়ের পর তৃতীয় সূত্র এবং তৃতীয়ের পর চতুর্থ সূত্রকে পর্যায়ক্রমে উপস্থাপিত করেন।