অথবা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্ব পরিবেশে কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ যুগপৎ প্রকৃতি ও সমাজ নামক দুটি স্বতন্ত্র পরিবেশের পরিধির মধ্যে বাস করে। প্রকৃতি হলো মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছা বা সচেতনতা নিরপেক্ষ স্বত্ব, বিরাজমান যাবতীয় উপাদানের সমষ্টি এবং সামজ হলো মানুষের ইচ্ছা, অভ্যাস ও সচেতনতার সাপেক্ষে বিরাজমান যাবতীয় উপাদানের সমষ্টি। বিভিন্ন দল, প্রতিষ্ঠান, রীতিনীতি, মূল্যবোধ ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে যেমন একটি সমাজব্যবস্থা গঠিত তেমনি জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, সংগঠন ও প্রযুক্তি
বিদ্যার সংমিশ্রণে পরিবেশ ব্যবস্থা গঠিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্ব পরিবেশ অবনয়নের জন্য বহুলাংশে দায়ী-উক্তিটির আলোচনায় সঙ্গতভাবে দুটি বিষয় আসে। যথা : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিশ্ব পরিবেশ অবনয়ন।
পরিবেশ : মানুষ এবং পরিবেশ অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। কারণ পরিবেশ মানবজীবনের বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ভালো পরিবেশে ভালো, আর খারাপ পরিবেশে খারাপ মানুষ তৈরি করে। পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের জন্য৷ প্রথম ও প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে সুস্থ ও শান্ত পরিবেশ। কিন্তু নানাবিধ কারণে পরিবেশ দূষণ এবং বেঁচে থাকার জন্য যে সুস্থতার প্রয়োজন পরিবেশ তা ক্রমে হারিয়ে ফেলছে। তাই সঙ্গত কারণেই বিশ্বব্যাপী মানুষ পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে।
পরিবেশের স্বরূপ : আমরা যে স্থানে বসবাস করি সে স্থান এবং তার আশপাশের অবস্থানকে পরিবেশ বলা হয় । ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, নদীনালা, মাটি, বায়ু, বিষয়সম্পত্তি এসব কিছু মিলে তৈরি হয় পরিবেশ। মানুষের আচার ব্যবহার ও
জীবনধারণ পদ্ধতি পরিবেশের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার সমাজ দ্বারাও পরিবেশ
প্রভাবিত হয়। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন কারণগুলোই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সমস্যার সাথে জড়িত। পরিবেশ ধ্বংসের
পিছনে মনুষ্য সষ্ট কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বন সম্পদের বিনষ্ট : প্রাচীনকালে মানুষ বাঁচার তাগিদে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর নির্মমভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। এটা পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। প্রত্যেক দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে বনাঞ্চল ৯%। আর এ নগণ্য বন সম্পদ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এটা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
২. রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার : ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদা মিটানোর জন্য জমিতে ভালো ও উন্নত জাতের ফসল ফলানোর এবং কীটপতঙ্গের হাত থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। ফলে জীবজগৎ, প্রাণিজগৎ এবং পরিবেশে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেটাকে আমরা পরিবেশের সমস্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকেই দায়ী করতে পারি। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পরিবেশ সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
৩. যুদ্ধ ও সংঘর্ষ : যুদ্ধ ও সংঘর্ষ জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির সাথে সাথে পরিবেশ সমস্যার সৃষ্টি করছে। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক অস্ত্রের জীবাণু মানবজীবন ও পরিবেশকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
৪. গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া : গ্রিন হাউস বা সবুজ ঘর বলতে কাচে ঘেরা ঘরকে বুঝায়। এর ভেতর সবুজ গাছপালা, শাকসবজি সীমিতভাবে চাষ করা হয়। কাচে ঘেরা ঘরে সূর্যকিরণ সহজে প্রবেশ কিন্তু তাপ তার মধ্যে থেকে বিকিরণ করে কাচ ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। ফলে গ্রিন হাউসের ভিতর তাপ বৃদ্ধি পায়। একইভাবে সূর্যরশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবী পৃষ্ঠে সহজে পৌঁছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে সব বিকিরণ সহজে মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না। ফলে
বায়ুমণ্ডলে তাপ বৃদ্ধি পায়। এভাবে যদি তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে তবে পৃথিবীর উপকূল ভাগ খুব দ্রুতই বন্যায় প্লাবিত হবে। এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং মালদ্বীপের মতো উন্নয়নশীল দেশের উপর।
৫. শব্দ দূষণ : জনগণের দ্বারা সৃষ্ট শব্দও পরিবেশ সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে। কলকারখানার বিকট আওয়াজ যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন, রেডিও, টেলিভিশন, ক্যাসেট প্লেয়ার ও মাইকের বিকট আওয়াজ৷ পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণের মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। হার্টের রোগ এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
৬. পানি দূষণ : আমাদের দেশের অধিকাংশ শিল্পই ঘনবসতিপূর্ণ নগর বা জনপদ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নদীর তীরে অবস্থিত। এগুলোর অধিকাংশ বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এসব শিল্পের বর্জ্য পদার্থ আশপাশ এলাকা বা নদীর পানিতে ফেলা হয়, যা পরিবেশে সমস্যার সৃষ্টি করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই পরিবেশের প্রতি মানুষের এরকম বিরূপ আচরণ পরিলক্ষিত হয়।
৭. বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের অপব্যবহার : আমাদের পরিবেশ সমস্যা সৃষ্টিকারী অপদ্রব্যের মধ্যে তামা, সীসা, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো প্রতিনিয়ত বায়ুকে দূষিত করছে। এ বায়ু দূষণ চলছে বিশ্ব জুড়ে। আর এগুলোর সবই মানুষের দ্বারা সৃষ্ট।
৮. খাদ্য ও পুষ্টিজ্ঞান : স্বাস্থ্য ও পুষ্টিদানের ব্যবস্থা চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করলে শিশু মৃত্যুহার কমে যাবে। ফলে অধিক সন্তান লাভের ধারণা দূর হবে। কিন্তু মানুষ তা সত্ত্বেও অধিক হারে সন্তান জন্ম দিচ্ছে।
৯. চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা : বাংলাদেশের জনগণ উন্নত বিশ্বের ন্যায় বিনোদন ভোগ করতে পারে না। এজন্য জন সাধারণের বিনোদনের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষামূলক যাত্রা পালাগানের আয়োজন করতে হবে। মানুষ বিনোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে জন্মহার কমে আসবে।
১০. সামাজিক নিরাপত্তা : অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অধিক সন্তান জন্ম দেয়। তবে ব্যাপক সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষ করে বার্ধক্য ভাতার ব্যবস্থা করা হলে অধিক সন্তান জন্মদানের স্পৃহা হ্রাস পাবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিশ্ব পরিবেশ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই এর অবনয়ন ও প্রতিবিধান নেয়া প্রতিটি দেশপ্রেমিক জনগণের উচিত। অন্যথায় বিশ্বের পরিবেশ মানুষের৷ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।