জনসংখ্যা বলতে কী বুঝায়? বাংলাদেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার
প্রভাবগুলো চিহ্নিত কর।
অথবা, জনসংখ্যা বলতে কী বুঝায়? বাংলাদেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে সংঘটিত
সমস্যাসমূহ চিহ্নিত কর।
অথবা, জনসংখ্যা কাকে বলে? অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলাফল লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। আবার এদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, এদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯২৮ (২০০৬ সালের হিসাব মতে) জন। এই অধিক জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত আমাদের আর্থ-
ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, মাদকাসক্তি, পুষ্টিহীনতা, দাম্পত্য কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, নৈতিক অধঃপতন প্রভৃতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির
ফলে আমাদের সমাজে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনসংখ্যা : কোনো নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও সুসংবদ্ধভাবে বসবাসরত বিভিন্ন বয়সের নারী ও পুরুষের সমষ্টিকে জনসংখ্যা বলে। এ জনসংখ্যা নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ, সমাজ ব্যবস্থা, বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা, জন্ম মৃত্যু, স্থানান্তরের গমনাগমন এবং এরূপ অন্যান্য বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শর্তসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত
হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, জনসংখ্যা বলতে একটি নির্দিষ্ট পরিসীমায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। অর্থাৎ ভৌগোলিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক কিংবা আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে যত মানুষ বসবাস করে তাদের সমষ্টিই হচ্ছে জনসংখ্যা। তাছাড়া সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুরুষ ও মহিলা জনসংখ্যার কথা বলা যেতে পারে। বস্তুত আমরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিশেষণ করি না কেন, নির্দিষ্ট অতিথি বা অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী সকল
মানবজাতিকে জনসংখ্যা বলে। তবে অতিথি বা অস্থায়ীভাবে বসবাসকারী বা বহিরাগতদেরকে জনসংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব : নিম্নে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আর্থ-সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. খাদ্য ঘাটতি : বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির উপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান। কারণ বর্ধিত লোকের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংস্থান করা সীমিত সম্পদের দ্বারা পূরণ করা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। ১৯৮৯-৯০ সালে ১ কোটি ৯৫ টন খাদ্য উৎপন্ন হয়। বর্ধিত লোকের ১৮.১৬ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের
উপর নির্ভর করতে হয়েছে। ১৯৯১-৯২ অর্থ বছরে বর্ধিত লোকের জন্য প্রায় ১৫.৬৩ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়।
সুতরাং দেখা যায় এত বর্ধিত জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত খাদ্য ঘাটতির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
২. মৌল মানবিক প্রয়োজন পূরণ : সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে সমাজে বসবাস করার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনোদনের চাহিদা পূরণ করা খুবই জরুরি। কিন্তু জনসংখ্যা স্ফীতির কারণে আমাদের দেশে এসব মৌল মানবিক চাহিদার কোনোটাই পরিপূর্ণভাব পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
৩. নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি : জনসংখ্যা বুদ্ধির ফলে আমাদের বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯১
সালের লোক গণনায় দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫১ ভাগের বয়স ১৫-৬৪ বছরের মধ্যে। কাজেই বাকি ৪৯ ভাগ নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতার ফলে সমাজে অভাব, অনটন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. বজ্র ঘাটতি : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বস্ত্রের ঘাটতি হচ্ছে। বাংলাদেশে্যপ্রতিবছর প্রায় ১২০ কোটি মিটার বস্ত্রের প্রয়োজন। অথচ বস্ত্রের উৎপাদন পরিমাণ এর চেয়েও অনেক কম। তার মধ্যে প্রতি বছর চলমান জনসংখ্যার সাথে বিপুল পরিমাণ নতুন মুখ যোগ হয়; যাদের জন্য আরও বাড়তি প্রায় ২৬ লক্ষ লোকের জন্য ২ কোটি ৬০ লক্ষ মিটার বস্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং দেখা যায় বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলেও প্রতিবছর
বস্ত্রের বিপুল পরিমাণ ঘাটতি হয়।
৫. বাসস্থান সমস্যা : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে বাসস্থান ও বস্তি সমস্যাও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা পরিদপ্তরের তথ্য অনুসারে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বার্ষিক ২ লাভ ৮১ হাজার নতুন বাসগৃহের প্রয়োজন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রতিগৃহে মোট জনসংখ্যার বসতি ছিল ৬ জন করে। কিন্তু বর্তমানে
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এ পরিমাণ বেশ বেড়েছে। কাজেই দেখা যায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের দেশে বাসস্থান সমস্যাকে
জটিল করে তুলেছে।৬. শিক্ষার সমস্যা ও নিরক্ষরতার সৃষ্টি : শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। এদেশে বর্তমানে
শিক্ষিতের হার ২২.৮। যে হারে লোক বাড়ছে সে হারে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বাংলাদেশে শিক্ষার হার আশানুরূপ ভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না, বরং নিরক্ষরতার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৭. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সমস্যা বৃদ্ধি : স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা মানুষের গুরুত্বপূর্ণ মৌল মানবিক চাহিদা। অথচ বাংলাদেশে
যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ প্রসূতি ও মায়ের মৃত্যু হয়।
৮. অবাদি ভূমির উপর চাপ বৃদ্ধি : জনসংখ্যাস্ফীতির ফলে আমাদের দেশে আবাদি জমির উপর ক্রমান্বয়ে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার বাসস্থান তৈরির জন্য আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পেতে চলেছে; যা সামগ্রিকভাবে কৃষি উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
৯. বেকারত্ব বৃদ্ধি : জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে বাংলাদেশে বেকারত্ব সমস্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্বের হার শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ। প্রতিবছর বেকারদের জন্য প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
১০. মূলধন গঠন ও শিল্পায়ন ব্যাহত : জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে মূলধন গঠন ও শিল্পায়ন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এর প্রভাবে আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে সঞ্চয় বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না।
১১. সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি : জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ-
সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অশান্তি, হতাশা, ব্যর্থতা, খুন, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১২. বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশে প্রতি বছর বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জনসংখ্যা সমস্যা আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও বৃহত্তর জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কাজেই এ সমস্যা প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সমাধান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।