জনমত একটি আপেক্ষিক বিষয় হওয়ায় জনমত গঠনের মাধ্যম গুলো স্থান-ব্যক্তি-সময় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় । তবে কিছু কিছু প্রধান মাধ্যমের কখনোই পরিবর্তন ঘটে না । জনমত গঠনে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যম। অতীতে পরিবার জনমত গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবারের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া গুলো ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় জনমত গঠনে পরিবারের ভূমিকা দিন দিন কমে আসছে । যাইহোক নিন্মে জনমত গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল ।
বর্তমান আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ । জনগণ তার প্রত্যক্ষ মতামতের মাধ্যমে পরোক্ষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে । জনগণ দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে মতামত প্রকাশ অধিকার রাখে । সকল ক্ষেত্রে জনগণ তার পূর্ণ বাকস্বাধীনতার চায় । তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিচে জনমত গঠনের মাধ্যম গুলো সম্পর্কে আমরা জানব।
জনমত গঠনের মাধ্যম : নিম্নে জনমত গঠনের মাধ্যম কি কি আলোচনা করা হলো-
পরিবারঃ রাষ্ট্রের সবচেয়ে আদি সংগঠন হচ্ছে পরিবার। পরিবার সকল ক্ষমতার মূলে কাজ করে । একটি পরিবার জনমত গঠনের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবারকে বলা হয় রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংগঠন। পরিবার আমাদের যা শিক্ষা দেয় আমরা তাই মেনে চলি। পরিবারের বয়স্করা যেমনঃ বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি যা সমর্থন করে স্বভাবতই আমরা তা সমর্থন করে থাকি। এই সমর্থন পরবর্তীতে মতামত হিসেবে প্রকাশ পায় এবং জনমত গঠন করতে সাহায্য করে।
যেমনঃ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দল সমর্থনের ক্ষেত্রে আমাদের পরিবার যে দলকে সমর্থন করে থাকে স্বভাবতই আমরা পরিবারের সদস্য হিসেবে সেই দলকে সমর্থন করে থাকি। এতে পরিবারের মতামত আমাদের মতামতের উপর প্রভাব বিস্তার করে ।
তবে জনমত গঠনে বর্তমানে পরিবারের ভূমিকা খুবই কম। এই বিংশ শতাব্দীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে পরিবারের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি এখন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে যার ফলে বর্তমানে পরিবার জনমত গঠনে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না। যদিও অতীতে জনমত গঠনে পরিবারের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কার্যকর। যাইহোক তবুও পরিবার জনমত গঠনের অন্যতম একটি মাধ্যম।
গণমাধ্যমঃ
বর্তমান বিশ্বের গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের একটি স্তম্ভ হিসেবে ধরা হয় । কয়েকশত বছর আগে যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে গণমাধ্যম ছাড়া বিশ্বকে কল্পনা করা যায় না। গণমাধ্যম যেমনঃ সংবাদপত্র-টিভি-রেডিও ইত্যাদি জনমত গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে । সরকারের ভুল ত্রুটি গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম সরাকারের সমালোচনা করার মাধ্যমে জনমত গঠনের চেষ্টা করে। গণমাধ্যম চেষ্টায় জনগণ তা স্পষ্টভাবে দেখতে ও বুঝতে পারে বিধায় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠিত হয়।
এছাড়াও সামাজিক সমস্যা, দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষের, সময় গণমাধ্যম উক্ত বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি সহ নানা ধরনের জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গণমাধ্যম শুধুমাত্র সরকারের বা সামাজিক সমস্যা বিরুদ্ধে নয় যেকোন সমস্যায় এবং বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে জনমত গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে । যেমনঃ খুন, ঘুম, দুর্নীতি, হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন ইত্যাদির ক্ষেত্রে গণমাধ্যম জনমত গঠনের অনেক বড় ভূমিকা রাখছে ।
এছাড়া বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে জনগণ সচেতন করার কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে গণমাধ্যম। এই সচেতনতার মাধ্যমেই জনমত গঠিত হয়। যাইহোক বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যমের গুরুত্ব সরকারের সাথে তুলন করা যায় ।
আইনসভা এবং জনপ্রতিনিধিঃ
আইনসভা বর্তমানে জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । আইনসভা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বৃন্দ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা সমালোচনা করে। যার ফলে কে ভাল কে মন্দ তা সহজে বুঝতে পারা যায়। জন প্রতিনিধিগণ আইনসভায় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নিজ দলের পক্ষে এবং অপর দলের বিপক্ষে বক্তব্যে যুক্তি প্রদান করে থাকে। এসব বিতর্ক রেডিও টেলিভিশনসহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় । জনগণ এর মূল্যায়ন এবং স্বাধীনভাবে তার নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে ।
এভাবেই আইনসভার মাধ্যমে শক্তিশালী জনমত গড়ে ওঠে। জনপ্রতিনিধিগণ অনেক সময় জনসমাবেশের মাধ্যমেও জনমত গঠন করে । এছাড়া দেশের পরিস্থিতি ও সমস্যা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। যা পরবর্তীতে জনমত গঠনে সাহায্য করে থাকে ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমঃ
জনমত গঠনের মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ একটি যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। আধুনিক তথা বিংশ শতাব্দীর তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির বিশ্বে সবচেয়ে বড় শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম । ধারণা করা হয় যে অদূর ভবিষ্যতে গণমাধ্যম যেমনঃ সংবাদপত্র, টিভি-রেডিও ইত্যাদির জায়গা দখল করে নিবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টার্নেট ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খবর ছড়িয়ে যায় । যার ফলে সচেতনতা মূলক যে কোন তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজে পৌঁছে যায় । এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে জনগণ সচেতন হওয়ার পাশাপাশি জনমত গঠনের একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে বর্তমান এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক বেশি যা গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে তুলনা মূলক অনেক কম ।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে জনমত গঠনের একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমস্যাটি হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক সময় অনেক ভুল ও ভ্রান্ত তথ্যের কারণে ভুল এবং ভ্রান্ত জনমত গড়ে ওঠে যা রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু জনমতের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ । অন্যদিকে মানুষ এই তথের সত্যতা যাচাই না করেই তার মতামত দেয় এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।
তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনমত গঠনের প্রক্রিয়া টি অনেক জটিল । জনমত গঠনের এই প্রক্রিয়াটি অদূর ভবিষ্যতে অন্যরকম একটি রূপ লাভ করবে যা সরকার এবং সচেতন জনগোষ্ঠীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ।
চলচ্চিত্র ও নাটকঃ
চলচ্চিত্র রেডিও ও টেলিভিশন জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর মানুষকে সংগঠিত ও প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র রেডিও-টেলিভিশনে ভূমিকা দিন দিন বেড়েই চলছে। বাস্তব ধর্মীয় চেতনা মূলক ছায়াছবি পরিবেশনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিদেশের খবরা-খবর সংবাদ পর্যালোচনা সমীক্ষা সমাজ সচেতন নাটক ইত্যাদি জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এছাড়া বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট এবং ইউটিউবে প্রযোজনায় সচেতনতা মূলক নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যেগুলোর মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা, সামাজিক অবক্ষয় এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে আমাদের সচেতনঅ,করা হয় ।যার মাধ্যমে আমরা সচেতন হয়ে জনমত গঠন করতে পারছি । তার মানে চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম ।
রাজনৈতিক দলঃ
রাজনৈতিক দল সংবাদপত্র, প্রচার-পুস্তিকা, সভা-সমিতি প্রভৃতির মাধ্যমে নিজ নিজ দলীয় কর্মসূচী প্রচার করে জনসমর্থন লাভের চেষ্টা করে। সরকারি দল চেষ্টা করে নিজেদের সফলতা প্রকাশ ও প্রচার করে জনমত গঠন করতে। আবার অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো সরকারের বিভিন্ন ভুল ত্রুটি জনগণের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা চালায়। যার ফলে জনগণ সরকার এবং বিরোধী দলীয় এসকল প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারে। এতে জনগণ তাদের নিজস্ব বুদ্ধি এবং বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে কোনটা ভুল কোনটা সঠিক তা নির্ণয় করতে পারে। যা এক ধরনের জনমত গঠন করতে পারে।
তার মানে রাজনৈতিক দল জনগণের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং জনমত গঠনের অন্যতম বড় ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক দলের বক্তব্য কর্মকাণ্ড জনগণের রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন করে তোলে। তার পাশাপাশি দেশের কল্যাণে জনগণকে একসাথে সঙ্গবদ্ধ হয়ে কাজ করার এক জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি করে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জন্মের পর থেকেই পরিবারের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাই। পরবর্তীতে আমরা বিদ্যালয় মাধ্যমে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ এবং সমাজের নানা বিষয়ের সম্পর্কে অবগত হই। যার ফলে আমাদের বাস্তবধর্মী জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
যারা বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রী তারা আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক আবার নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষা লাভ করে তা পরবর্তীতে তাদের জীবনের স্থায়ী প্রভাব ফেলে। শিক্ষকগণ আদর্শ বা ধ্যান-ধারণাকে কল্যাণকর গ্রহণযোগ্য বলে যুক্তি প্রদর্শন করেন, ছাত্র ছাত্রীরা অনেকেই সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে তার জীবনে সে রকম কাজকর্ম করতে চায়। সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তারা দেশের কল্যাণ সহ সমাজের জন্য নানা ধরনের কাজ করে থাকে। এভাবেই মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনমত গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীঃ
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বর্তমানে জনমত গঠনে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করে। আমরা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলতে বুঝি, যারা অরাজনৈতিক সংগঠক হয়ে আড়ালে গোপনীয় ভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়ন করিয়ে নেয়। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে সরকার যখন তাদের স্বার্থ বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড লিপ্ত হয়। তখন সরকারের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন মিটিং মিছিল এবং জনসমাবেশ করে জনগণকে সচেতন করে থাকে। তার পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে তারা জনমত তৈরির প্রচেষ্টা চালায়।
এছাড়া বর্তমান সময়ে চাপ সৃষ্টিকারী লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হয়েছে তারা বর্তমান সময়ের জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বর্তমানে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে থাকে ।
ধর্মীয় সংগঃ
অনেক সময় জনমত গঠনের ধর্মীয় সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেননা ধর্ম সংঘ গুলো আলোচনা উপদেশ জনগণকে অনেক প্রভাবিত করে থাকে। মসজিদ-মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশ আমাদের অনেক প্রভাবিত করে। আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়ে ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে যখন কোনো ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা হয় তখন আমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুভূতির স্থান থেকে তা মেনে চলার চেষ্টা করি। অথবা যিনি আমাদের ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন তার কথাগু