অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) অস্তিত্ব প্রমাণ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদ কিভাবে আস্তিক
শ্রেণীর দার্শনিক জড়বাদী ও নাস্তিক শ্রেণীর দার্শনিকদের মতের সমন্বয়সাধন করেন?
অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) অস্তিত্ব প্রমাণ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদের অভিমত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জগতের সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) অস্তিত্ব প্রমাণ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদের অভিমত বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ইবনে রুশদ মুসলিম জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হিসেবে পরিগণিত। ইউরোপীয়রা তাকে . সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ও এরিস্টটলের প্রখ্যাত ভাষ্যকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, একটি সত্যিকারের ধর্ম হিসেবে ইসলাম দর্শন চর্চার বিরোধী নয়, বরং দর্শনের অধ্যয়নকেই উৎসাহিত করে। ধর্মতাত্ত্বিক ও
দার্শনিক উভয়েরই আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মুসলিম দার্শনিকরাও বিষয়টিকে কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমিত না করে এ সম্পর্কে দার্শনিক যুক্তির অবতারণা করেছেন।
আল্লাহর অস্তিত্ব : ইবনে রুশদ দর্শন ও ধর্মের আলোচনায় দেখাতে সক্ষম হন যে, ধর্মের বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে। তার মতে, আল্লাহর একত্ব, গুণাবলি, পূর্ণতা, ন্যায়পরতা, জগতের সৃষ্টি, নবুয়তের বৈধতা, মরণোত্তর জীবন প্রভৃতি ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ধর্মবেত্তা, দার্শনিক ও সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সবার পক্ষেই এসব
উপকরণসমূহে বিশ্বাস অপরিহার্য। নিম্নে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে ইবনে রুশদের অভিমত ব্যাখ্যা করা হলো :
প্রথমত, ইবনে রুশদ ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয়সাধনের পর তার ‘আল – কাশফ আন মানাহিজুল আদিল্লাহ’ শীর্ষক গ্রন্থে আল্লাহর অস্তিত্ব ও আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কিত বিশ্বাস অর্জনে কুরআনে বর্ণিত পদ্ধতি জানার প্রচেষ্টা চালান। তিনি আল্লাহর অস্তিত্বের সপক্ষে কুরআনে বর্ণিত মূল বাণীর আলোকে আল্লাহর বদান্যতা বিষয়ক প্রমাণ ও সৃষ্টি বিষয়ক প্রমাণ
নামে অভিহিত দার্শনিক যুক্তির সাহায্য নেন। প্রথম প্রমাণটিকে তিনি আবার উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতিমূলক এবং দ্বিতীয় প্রমাণটিকে বিশ্বতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করেন।
দ্বিতিয়ত, ইবনে রুশদ বলেন, আল্লাহর বদান্যতা বিষয়ক প্রমাণটি দুটি নীতির উপর নির্ভরশীল । যথা :
১. সকল বস্তু সত্তা বা জিনিস হলো এমন যেগুলো মানুষের অস্তিত্বের পক্ষে উপযোগী এবং
- এ উপযোগিতা আকস্মিকভাবে সৃষ্ট হয় নি, বরং একজন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বা পরিকল্পনা অনুযায়ী আবশ্যিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানুষের সেবা ও কল্যাণের জন্য এ সকল জিনিসের সৃষ্টির গূঢ়ার্থে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের সপক্ষে প্রমাণের ইঙ্গিত বহন করে।
তৃতীয়ত, প্রাণী, উদ্ভিদ ও মহাকাশের বিবেচনার উপর সৃষ্টি বিষয়ক প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত । এ প্রমাণটি আবার দুটি নীতির উপর নির্ভরশীল । যথা : (১) সকল জিনিসই সৃষ্ট এবং (২) প্রতিটি সৃষ্ট জিনিসই একজন স্রষ্টার প্রয়োজনের কথা বলে। উদাহরণস্বরূপ নিষ্প্রাণ দেহে প্রাণের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করে আমরা এটা অনুমান করতে পারি যে, অবশ্যইএ প্রাণের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। আর তিনি হলেন আল্লাহ। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে তা আল্লাহরই নির্দেশে
সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
চতুর্থত, আল্লাহর অস্তিত্বের জন্য এ দুটি প্রমাণ বা পন্থা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। তবে এ জানার পদ্ধতির ক্ষেত্রে জ্ঞানের মাত্রার মধ্যে পার্থক্যটুকু এ যে, সাধারণ মানুষ বাহ্যিক বা আলংকারিক অর্থে এবং প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে জানার প্রয়াস পান।
পঞ্চমত, জগৎকে জড়বাদী ও নাস্তিক দার্শটি করা সৃষ্ট মনে করে না। তাদের মতে, জগৎ অনাদি। ফলে অনাদি জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা বা কারণ থাকার দরকার নেই। এটাই জড়বাদী ও নাস্তিক দার্শনিকদের মূলকথা, দার্শনিকদের যুক্তি ও অন্যান্য যুক্তি পর্যালোচনা করে ইবনে রুশদ দেখান যে, উভয় দলের মতামতের মধ্যেই কিছু ভালোমন্দ দিক বিদ্যমান
রয়েছে। অবশ্য দার্শনিকদের মতকে তিনি একটি দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নততর বলে অভিহিত করেছেন।
ষষ্ঠত, জগতের সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে ইবনে রুশদ বলেন যে, এক ধরনের কর্তা থাকতে পারে যে কর্তা কোনকিছু সৃষ্টি করেন। কেবল ঐ সৃষ্টির সময়েই তার সাথে যুক্ত থাকেন বা ঐ সৃষ্টির সাথে কেবল সৃষ্টিকালীন সময়েই সম্পর্ক রাখেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যে কোন পেশাদার গৃহনির্মাতা কেবল কোন নির্দিষ্ট গৃহনির্মাণাধীন সময়ে ঐ গৃহের সাথে যুক্ত
থাকনে বা ঐ গৃহে থাকেন। তবে তাঁর নির্মাণ সমাপ্তি হয়ে গেলে তিনি ঐ নির্দিষ্ট গৃহে অবস্থান করেন না। তিনি আরো বলেন, এমন এক কর্তার কথা ভাবা যায়, যে কর্তা শুধু সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হন না, বরং সৃষ্টিকে তার উপর নির্ভরশীল করে রাখেন। তার অবস্থিতি সৃষ্টির সাথে আবশ্যিক হয়ে পড়ে।
মূল্যায়ন : ইবনে রুশদ আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা মুসলিম দর্শনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এক পরম সত্তা, কোন সত্তা আল্লাহর উপর ভাবা যায় না। যদি আল্লাহর চেয়ে কোন বড় সত্তার ধারণা করা হয়, তাহলে আল্লাহর ধারণাই বিনষ্ট হয়। আবার আল্লাহর অস্তিত্ব অন্য কোন সত্তার উপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়, তবে আল্লাহর চেয়ে বড় কোন সত্তার ধারণা স্বীকার করে নিতে হয়। ফলে কোন শর্তসাপেক্ষ বা অন্য কোন সত্তা দ্বারা আল্লাহর অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রিত ভাবা যায় না। সুতরাং যে কোন মুসলমানেরই আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকাই অবাঞ্ছিত।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, জগতের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ প্রসঙ্গে ইবনে রুশদের মতবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তিনি আস্তিক শ্রেণীর দার্শনিক জড়বাদী ও নাস্তিক শ্রেণীর দার্শনিকদের মতের সমন্বয় করে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে সক্ষম হন। তাছাড়া তিনি আস্তিক শ্রেণীর দার্শনিকদের যুক্তি সমর্থন করলেও জড়বাদী ও নাস্তি কদের যুক্তিও পর্যালোচনা করেন। সুতরাং মুসলিম দর্শনে ইবনে রুশদের অবদান অনস্বীকার্য ।