অথবা, সার্থক প্রেমের গল্প হিসেবে ‘একরাত্রি’ গল্পটি কতটুকু শিল্পোত্তীর্ণ তা আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : বর্তমানে সাহিত্যের সবচাইতে জনপ্রিয় শাখা হলো ছোটগল্প। স্বল্প সময়ে সাহিত্য পাঠে আনন্দ লাভের একমাত্র মাধ্যম ছোটগল্প। আর রবীন্দ্রনাথই হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যে এ জনপ্রিয় মাধ্যমটির পথপ্রদর্শক ও শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। শতাধিক শিল্পসফল গল্প রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যের এ শাখাটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। ‘একরাত্রি’ তাঁর একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পসফল গল্প হিসেবে স্বীকৃত।
ছোটগল্পের সংজ্ঞা : ছোটগল্প লেখকের আত্মসচেতন সৃষ্টি। যে কোন সৃষ্টিকর্মকে সংজ্ঞার বাধনে বাঁধা অসম্ভব। তবুও কিছু কিছু লক্ষণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন মনীষী ছোটগল্প সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। আমেরিকার প্রখ্যাত গল্পকার ই. এ. পো-র মতানুসারে, “যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দু ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোটগল্প বলে।” ইংরেজ গল্পকার এইচ জি ওয়েলস (H. G. Wells) বলেন, “ছোটগল্প দশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।” প্রখ্যাত, সাহিত্যসমালোচক প্রথম চৌধুরীর মতে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু যেমন বিচিত্র তেমনি তার পরিবেশনও ততোধিক বিচিত্র। ছোটগল্প বলতে শুধু কাহিনি বর্ণনা বুঝায় না। ছোটগল্প শুধু আখ্যান রচনা নয়, শুধু চরিত্র সৃষ্টিও নয়, ছোট গল্প একটি বিশিষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি, একটি বিশেষ রূপসৃষ্টি।”
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য :
১. ছোটগল্প আকারে ছোট হবে এবং একটি পরিপূর্ণ গল্পরূপ লাভ করবে।
২. ছোটগল্প জীবনের একটি খণ্ডাংশে রূপায়িত হয়।
৩. এতে অনাবশ্যক কথা, অনাবশ্যক ভাষা, অনাবশ্যক চরিত্র ও ঘটনা প্রভৃতি নিষ্ঠুরভাবে বর্জন করা হয়।
৪. জীবনের একটিমাত্র রূপ বা ঘটনা ছোটগল্পের উপজীব্য।
৫. ছোটগল্পের আরম্ভে ও উপসংহারে নাটকীয়তা থাকবে।
ছোটগল্পের প্রকৃতি ও গঠনরীতি : রবীন্দ্রনাথ তার ‘সোনারতরী’ কাব্যের ‘বর্ষাযাপন’ নামক কবিতায় আপনার অজানিতে যা বলেছেন তাতেই ছোটগল্পের প্রকৃতি ও গঠনরীতি স্পষ্ট হয়ে পড়েছে-
ছোটপ্রাণ ছোটব্যথা,
ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্তৃতি রাশি
প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা
ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে
সাঙ্গ করি মনে হব
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
ছোটগল্প হিসেবে ‘একরাত্রি’ : ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যের আলোকে ‘একরাত্রি’ একটি সার্থক ছোটগল্প। এ গল্পে মানবজীবনের একটি বিশেষ অনুভূতিকে রূপায়িত করা হয়েছে। একটি রাতের ক্ষণমুহূর্ত ও নায়কের আত্মোপলব্ধি এ গল্পের মূল উপজীব্য। এখানে অনাবশ্যক কোন চরিত্রের উপস্থিতি নেই; সমস্ত গল্পটি নায়কের জবানীতে ব্যক্ত করা হয়েছে। আয়তনের দিক থেকেও গল্পটি ছোট। কাহিনিটি বর্ণনার জন্য গল্পকার বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। গল্পটির আরম্ভে এবং উপসংহারে নাটকীয়তা বিদ্যমান।
একরাত্রি গল্পের মূল বিষয় : অস্থিরচিত্ত নায়কের ভাবকল্পনা এবং বাস্তব জীবনানুভূতির এক অপূর্ব কাহিনি ‘একরাত্রি’। এ গল্পের নায়ক-নায়িকা একে অপরের প্রতিবেশী ও খেলার সাথী। ছোটবেলা থেকে তাদের ভিতরে অনুরাগের সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য নায়ক পাড়ি জমায় কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে নানা ভাবকল্পনায় বিভোর হয়ে ভুলে যায় বাল্য প্রণয়িত্রী সুরবালার কথা। ইতোমধ্যে সুরবালার বিয়ে হয়ে যায় সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের সাথে। ভাগ্য বিপর্যয়ে নায়কের ঠাঁই হয় সুরবালার বাড়ির অনতিদূরে এক স্কুলে। অবশেষে বিরহদীর্ণ দুটি মানব-মানবীকে প্রকৃতি এনে দেয় খুব কাছাকাছি। প্রণয়িনীর এ মুক মিলনে নায়কের মনে হয়েছে যে, সে একটি অনন্ত আনন্দের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে।
একরাত্রি গল্পের বৈশিষ্ট্য : ‘একরাত্রি’ রবীন্দ্রনাথের একটি শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক প্রেমের গল্প। ‘একরাত্রি’ গল্পের যে প্রেম তা সকল পার্থিব কামনা-বাসনার ঊর্ধ্বে। একরাত্রি গল্পের প্রেম সাধারণ মানুষের আত্মহারা আবেগময় প্রেম নয়। দুর্যোগপূর্ণ রাতে তারা কাছাকাছি এসেও থেকেছে শাস্ত সমাহিত। কেউ কাউকে একটি কুশল পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেনি। তাদের মূক আচরণ বলে দেয় তাদের বিশ্বাস ও ভালাবাসার গভীরতা কত ব্যাপক। রবীন্দ্রপ্রেমের চিরন্তন সৌন্দর্যই ‘একরাত্রি’ গল্পের মূল সুর।
ছোটগল্প হিসেবে একরাত্রির সার্থকতা : ছোটগল্পের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যানুসারে বিচার করলে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ একটি সার্থক ছোটগল্প। ছোটগল্প একটিমাত্র কাহিনির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ‘একরাত্রি’ গল্পটি একটি রাতের বিশেষ মাহাত্ম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ‘একরাত্রি’ গল্পের যা কিছু আয়োজন তা ঐ একটি রাতকে কেন্দ্র করে। চরিত্রের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ গল্পে অনাবশ্যক কোন চরিত্রের উপস্থিতি নেই। নায়ক ছাড়া এ গল্পে সুরবালা ও রামলোচন উকিলের উপস্থিতি গল্পে সামান্যই। সমস্ত গল্পটি নায়কের জবানিতে উপস্থাপিত। ছোটগল্পের যে মূল বৈশিষ্ট্য গল্পের শুরুতে এবং উপসংহারে নাটকীয়তা থাকবে; তা এ গল্পে বিদ্যমান। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে ‘সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি এবং বউ বউ খেলিয়াছি’। আর গল্পটির ইতি টানা হয়েছে প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়ের একটি অনন্ত রাত্রির ভিতর দিয়ে। যেখানে নায়ক-নায়িকা কাছাকাছি হয়েও নীরবে আবার প্রস্থান করেছে নিজ নিজ গন্তব্যে।
উপসংহার : আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, ছোটগল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই এ গল্পে বিদ্যমান। বিষয় নির্বাচনে এবং আঙ্গিক ও প্রকাশভঙ্গির স্বাতন্ত্রে এ গল্পটি বাংলা ছোটগল্পে স্বতন্ত্র মর্যদার দাবি রাখে। জীবনের ক্ষণবৃত্তে অনন্ত জীবনের ব্যঞ্জনায় ‘একরাত্রি’ একটি অনন্য শিল্পসফল ছোটগল্পের স্বীকৃতি লাভ করেছে।