ছয়দফা কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল? আগরতলা মামলার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

অথবা, ছয়দফা কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল? আগরতলা মামলার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠে। শাসনতন্ত্রে তাদের কর্তৃত্ব ছিল সর্বাধিক। তারা কেন্দ্র থেকে প্রদেশকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো, ফলে প্রদেশে শোষণের চিত্র প্রকট রূপ ধারণ করে। বিশেষকরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের আগ্রাসনের শিকার হয়। এ সময় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ শিরোনামে ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে।
ছয়দফা কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : পাকিস্তান আমলে বাঙালির তথা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছয়দফা কর্মসূচির ঘোষণার মাধ্যমে। ছয়দফা
কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নিম্নরূপ :
১. স্বাধিকার অর্জন : ছয়দফা কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ছিল বাঙালির স্বাধিকার অর্জন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের অপশাসন থেকে বের হওয়ার জন্য স্বাধিকার অর্জনের উপর জোর দেন।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার সবটুকু প্রয়োগ করতো। তারা পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করতো। তাই স্বাধিকার অর্জন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস করা ছয়দফার লক্ষ্য ছিল।
৩. অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা : ছয়দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব সম্পদ, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়, বৈদেশিক আয় প্রভৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়; যাতে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। প্রদেশের সম্পদ দিয়ে প্রদেশের জনগণের কল্যাণসাধন করা যায়।
৪. প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা : ১৯৬৫ সালে সংগঠিত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে অনিরাপদ ছিল। ১৭ দিন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থে পরিচালিত সামরিকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের কোনো কাজেই আসেনি। তাই ছয়দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রস্তাবে দাবি করা হয়।
৫. স্বাবলম্বী হওয়া : ছয়দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়।
৬. স্বাধীনতার পথে যাত্রা : ছয়দফা কর্মসূচিকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ, বাঙালির বাঁচার দাবি। মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয় এবং ক্রমশ মুক্তির পথে অগ্রসর হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে ছয়দফা আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
আগরতলা মামলার প্রতিক্রিয়া : ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। ছয়দফা আন্দোলন সকলের আন্দোলনে পরিণত হয়। আন্দোলন ছিল সুসংগঠিত এবং সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাছে এ আন্দোলন গ্রহণযোগ্য ছিল না। কেননা ছয়দফা মেনে নিলে কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত ক্ষমতা হ্রাস পাবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, পূর্ব পাকিস্তানের মিলিশিয়া গঠনের প্রস্তাব পশ্চিম পাকিস্তানিদের শঙ্কিত করে তোলে।
তাই পাকিস্তান সরকার স্বাধিকার আন্দোলনকে দমন করার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। আন্দোলনকারীদেরকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাজানো হয় দেশদ্রোহীতার মামলা। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের এ ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা আমলে না নিয়ে বরং ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ১৯৬৮ সালে ১৯ জুন বিচার কাজ শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়ায় সারাদেশে হরতাল অবরোধ চলতে থাকে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি হয়ে উঠলো আন্দোলনের প্রধান বিষয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে গঠন করে ‘ড্যাক’। আন্দোলন আরো জোরদার হলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি করে এবং প্রতিহিংসাবশত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট ফজলুল হককে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হত্যা করে। কিন্তু প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় এবং আসামিদের মুক্তি দেয়া হয়।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাসমূহ পরস্পরের সাথে যুক্ত। ৬ দফা আন্দোলন দমন করতে আগরতলা মামলা দেয়া হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তা প্রত্যাহারও করা হয়। এ সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে ৬ দফা কর্মসূচি ও আগরতলা মামলার পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা হলো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।