অথবা, চার্বাকরা বিশুদ্ধ জড়বাদী কি না তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, চার্বাক জড়বাদী মতবাদকে বিশুদ্ধ জড়বাদ বলা যায় কি না তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দর্শন এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। চার্বাক দর্শন জড়বাদী দর্শন । চার্বাক দর্শন তার জ্ঞানতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। চার্বাক দর্শন সম্পর্কে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ নেই। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে চার্বাক দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই বলা হয় যে, চার্বাক দর্শন
অতি প্রাচীন।
বিশুদ্ধ জড়বাদ : বিশুদ্ধ জড়বাদী মতবাদে জড়কে জগতের একমাত্র আদিসত্তা মনে করা হয়। এ মতবাদ অনুসারে জড় থেকেই জগতের সবকিছুর উদ্ভব। এমনকি প্রাণ এবং মনও জড় থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
চার্বাক জড়বাদ : ভারতীয় দর্শনে চার্বাক জড়বাদীরা উল্লেখ করেন যে, জড়বস্তুই জগতের আদিসত্তা। জড় থেকেই জগৎ তথা এর অন্তর্নিহিত সবকিছুর উদ্ভব। কারণ জড়ই একমাত্র প্রত্যক্ষগোচর। জড় ভিন্ন অন্য কোন বস্তু প্রত্যক্ষগোচর নয়।
জগৎ গঠনকারী উপাদান : চার্বাকরা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ- এ চারটি মহাভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। তাদের মতে, এ চারটি পদার্থই বাস্তবে প্রত্যক্ষগোচর হয়। এ চারটি মৌলিক পদার্থই সূক্ষ্মতর বস্তুতে অবিভাজ্য এবং পরস্পরের সংমিশ্রণের ফলে যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টি হয়।
অতীন্দ্রিয় বিষয়ের সত্তা : চার্বাকদের মতে, ঈশ্বর আত্মা, স্বর্গ, নরক এবং অদৃষ্টশক্তি প্রভৃতি সত্তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। কারণ প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোন বাস্তব সত্তা নেই। বস্তুত, জড়বস্তুরই কেবল সত্তা আছে। অতীন্দ্রিয় যেহেতু প্রত্যক্ষগোচর নয়, সেহেতু তার কোন সত্তা নেই।
জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি : চার্বাকরা বলেন, ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ- এ চারটি জড় উপাদান নিজ নিজ অন্তর্নিহিত স্বভাবত ক্রিয়া করে এবং তার ফলে এ জগৎ ও সব জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এবং জগৎ জড় উপাদানের স্বাভাবিক পরিণতি।
অস্তিত্ব প্রত্যক্ষনির্ভর : চার্বাকদের মতে, কেবলমাত্র প্রত্যক্ষিত বস্তুই অস্তিত্বশীল। ব্যোমকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। তাই ব্যোম পদার্থ বলে স্বীকৃত নয়। অনেক ভারতীয় সম্প্রদায় ব্যোমকে একটি ভাব পদার্থ বলে স্বীকার করে নিলেও চার্বাকরা বলেছেন যে, অনুমানসাপেক্ষ কোন দ্রব্যকে নিত্য বলে স্বীকার করা যায় না।
কার্যকারণ সম্বন্ধ : চার্বাক জড়বাদী দর্শনে কার্যকারণ সম্বন্ধকে অস্বীকার করা হয়। তাদের মতে, আমরা দুটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করি মাত্র। কিন্তু দুটি ঘটনা যে কার্যকারণ নামে একটি নিরবচ্ছিন্ন এবং সার্বিক সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা আমরা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে স্থির করতে পারি না।”
দেহাতিরিক্ত আত্মা : চার্বাক জড়বাদে দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় নি। চার্বাকদের মতে, চেতনা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বলে চেতনার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এর আধাররূপে আত্মার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
জগতের সৃষ্টিকর্তা : যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয় নয় সেহেতু চার্বাক দর্শনে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। জড় উপাদানের দ্বারাই জগৎ সৃষ্টি এবং এ জগতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে কোন জগৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান করা নিষ্প্রয়োজন।
চার্বাক জড়বাদ বিশুদ্ধ জড়বাদ : চার্বাকদের জড়বাদ অচেতন জড়পদার্থকেই একমাত্র সত্তা বলে স্বীকার করে। তাদের মতে, এ জড়পদার্থগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্নভাবে জগতের সবকিছুর সৃষ্টি করেছে। জড় ভিন্ন অন্য কোনকিছুর সত্তা স্বীকার না করার কারণে চার্বাক জড়বাদকে বিশুদ্ধ জড়বাদ বলা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে
পারি যে, জড়বাদী হিসেবে চার্বাকরা জগৎ এবং যাবতীয় বিষয়বস্তুর যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীতে তাদের মতবাদের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা উপস্থাপিত হলেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে চার্বাকদের জড়বাদী মতবাদের গুরুত্ব অপরিসীম