অথবা, চার্বাক দর্শন অনুসারে জীবনের পরম পুরুষার্থ কী?
অথবা, জীবের চরম উদ্দেশ্য কী? চার্বাকদের অনুসরণে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শনের মতে, জড়পদার্থই একমাত্র সত্তা। চার্বাক দর্শন নিছক জড়বাদী বলে এটা আত্মা ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। চার্বাক দর্শন সম্পর্কে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ পাওয়া যায় নি। তবুও এ দর্শন যে অতি প্রাচীন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বেদ, রামায়ণ, মহাভারত এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যের স্থানে স্থানে এ মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চার্বাক দর্শনের মূলকথা : চার্বাক দর্শন বিশুদ্ধ ভোগবাদী দর্শন। ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতবাদে স্বর্গমুখ ভোগকেই জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈদিক ক্রিয়া কর্মের দ্বারা এ স্বর্গসুখ লাভ করা যায় বলে তারা মনে করেন। কিন্তু চার্বাকরা মৃত্যুর পর কোন জীবনের অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। সুতরাং মৃত্যুর পর কোন স্বর্গসুখ ভোগের প্রশ্নই আসে না।
মানব জীবনের পরম কাম্য : মোক্ষ লাভকেই জীবনের পরম কাম্য বলে অধিকাংশ ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় মনে করে। কিন্তু চার্বাকরা এ মতকে স্বীকার করেন না। তাদের মতে, আত্মার যেহেতু কোন সত্তা নেই তখন তার বন্ধন মুক্তির কোন প্রশ্ন আসে না । মৃত্যুতেই কেবল দুঃখের আত্যত্তিক নিবৃত্তি সম্ভব। তাই মানব জীবনের পরম কাম্য বস্তু হলো সুখ লাভ
করা। সুখই মানুষের পরম কল্যাণ।
ইন্দ্রিয় সুখের প্রাধান্য : চার্বাকদের মতে, সুখ ভৌগই জীবনের পরম কাম্যবস্তু বা পরম পুরুষার্থ। তারা আরো বলেছেন, ইন্দ্রিয় সুখই জীবনের পরম কল্যাণ বা পুরুষার্থ। জগতে যত রকমের সুখ আছে তার মধ্যে ইন্দ্রিয় সুখই শ্রেষ্ঠ এবং ধ্রুব।
পার্থিব সুখই স্বর্গসুখ : চার্বাকরা মনে করেন দেহের বিনাশেই চেতনার বিনাশ এবং যেহেতু আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই সেহেতু মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ ভোগের কোন প্রশ্নই উঠে না। স্বর্গ ও নরক বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। এগুলো ভণ্ড পুরো হিতদের সৃষ্ট ধারণা মাত্র। কাজেই পার্থিব সুখই স্বর্গ আর পার্থিব দুঃখই নরক।
মানসিক সুখের গুরুত্ব : চার্বাকরা ইন্দ্রিয় সুখকে মানসিক সুখের তুলনায় অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছেন। যথাসম্ভব দুঃখ পরিহার করে সর্বাধিক পরিমাণ ইন্দ্রিয় সুখ লাভই মানব জীবনের চরম লক্ষ্য। যে কাজে দুঃখের তুলনায় সুখ বেশি সে কাজ ভাল আর যে কাজে সুখের তুলনায় দুঃখ বেশি সে কাজ মন্দ।
পারলৌকিক ক্রিয়া অর্থহীন : পারলৌকিক সুখের আশায় কৃত বৈদিক যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠানকে চার্বাকরা উপহাস করেন। তাদের মতে, স্বর্গ, নরক, পরজগৎ প্রভৃতির অস্তিত্ব অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। পরলোকে সুখ প্রাপ্তির জন্য পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান অর্থহীন বলে চার্বাকরা মনে করেন।
অবিমিশ্র সুখ সম্ভব নয় : চার্বাকদের মতে, এ জগতে অবিমিশ্র সুখ ভোগ সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে জাগতিক সুখের সাথে দুঃখ মিশে আছে বলে সুখ অন্বেষণ থেকে বিরত থাকা মূর্খতার শামিল। দুঃখ মিশ্রিত বলে ভোগের জন্য সুখকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়।
দুঃখ অবর্জনীয় : যা সুখের সাথে এসে পড়ে তা অবর্জনীয়। এরূপ দুঃখ স্বীকার করে নিয়েই সুখকে ভোগ করতে হবে। যদিও সুখ ভোগ করতে গিয়ে দুঃখ অপরিহার্য, তথাপি তাকে যথাসম্ভব পরিহার করে সুখ ভোগ করাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য। তাছাড়া চার্বাকরা বলেছেন যে, দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মাধুর্য। চার্বাকরা একটি বিষয়ের উপর খুবই গুরুত্ব দিতে বলেছেন, আর তা হলো দুঃখের পরিমাণ যেন কখনই সুখের চেয়ে বেশি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চার্বাকরা ইন্দ্রিয় সুখকে সবচেয়ে বেশি প্রধান্য দিয়েছেন। তাদ
ের মতে, মানব জীবনের পরম কাম্য বস্তু হলো সুখ লাভ করা। সুখই মানুষের পরম কল্যাণ। তারা অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি। তাই জাগতিক সুখের উপর প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা তাদের দার্শনিক চিন্তাধারার মূল বিষয় হিসেবে ইন্দ্রিয় সুখের কথা বলেছেন।
