চার্বাক দর্শনের মতবাদগুলো সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, চার্বাকদের দার্শনিক মতবাদগুলো কী কী?
অথবা, চার্বাকরা দর্শনের কয়টি মতবাদের কথা বলেছেন?
উত্তর ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে চার্বাক দর্শন এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। চার্বাক দর্শন জড়বাদী দর্শন। চার্বাক দর্শন তার জ্ঞানতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। চার্বাক দর্শন সম্পর্কে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ নেই। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে চার্বাক দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই চার্বাক দর্শন অতি প্রাচীন।
চার্বাক দার্শনিকরা তাদের নিম্নলিখিত মতবাদসমূহের কারণে বিখ্যাত।
১. কল্যাণ মতবাদ : চার্বাকদের মতে, ঈশ্বর, আত্মা, স্বর্গ, নরক এবং অদৃষ্টশক্তি প্রভৃতি সত্তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা যায় না। কারণ প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোন সত্তা নেই। বস্তুত জড়বস্তুরই সত্তা আছে। অতীন্দ্রিয় যেহেতু প্রত্যক্ষগোচর নয়, সেহেতু তাই কোন সত্তা নেই। আর তাছাড়া অতীন্দ্রিয় বিষয়াবলি কোন বাস্তব কল্যাণে কাজে আসে না।
২. বস্তু সম্পর্কিত মতবাদ : চার্বাকরা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ- এ চারটি মহাভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। যেহেতু ব্যোমকে প্রত্যক্ষ করা যায় না, সেহেতু এর কোন অস্তিত্ব নেই। প্রত্যক্ষগ্রাহ্য চারটি মহাভূতের দ্বারাই জগৎ গঠিত। কেবলমাত্র জড়বস্তু নয়, জীবদেহতে এ চারটি মহাভূতের সৃষ্টি।
৩. চেতনা সম্পর্কিত মতবাদ : চার্বাক মতে, চেতনা যেহেতু প্রত্যক্ষগ্রাহ্য সেহেতু তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আত্মার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। চেতনা দেহের ধর্ম, কোন অপ্রত্যক্ষগ্রাহ্য অতীন্দ্রিয় সত্তা বা আত্মা ধর্ম নয় ৷ চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা। দেহাতিরিক্ত কোন অতীন্দ্রিয় আত্মার অস্তিত্ব নেই।
৪. আত্মার অমরতা সম্পর্কিত মতবাদ : চার্বাক মতে, চৈতন্য হলো উপবস্তু। দেহ ভিন্ন চৈতন্যের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। যেহেতু দেহ ভিন্ন চৈতন্যের অস্তিত্ব নেই, সেহেতু আত্মার অমরতার প্রশ্ন অবান্তর। দেহের মৃত্যুতেই জীবনের পরিসমাপ্তি। জন্মান্তর, পরলোক, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি কতকগুলো অর্থহীন শব্দ মাত্র।
৫. ধর্ম সম্পর্কিত মতবাদ : যেহেতু ঈশ্বর প্রত্যক্ষের বিষয় নয় সেহেতু চার্বাক দর্শনে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। জড় উপাদানের দ্বারাই জগৎ সৃষ্টি এবং এ জগতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে কোন জগৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুমান করা নিষ্প্রয়োজন।
৬. জগৎ সৃষ্টির মতবাদ : ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ- এ চারটি জড় উপাদান নিজ নিজ অন্তর্নিহিত স্বভাব ধর্মবশত ক্রিয়া করে এবং তার ফলে এ জগত্ত সব জাগতিক বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এবং জগৎ জড় উপাদানের স্বাভাবিক পরিণতি।
৭. মুক্তির ধারণা সম্পর্কিত মতবাদ : চার্বাকরা মৃত্যুর পর কোন জীবনের অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। সুতরাং মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ ভোগের কোন প্রশ্নই উঠে না। আবার মোক্ষ বলতে কেউ কেউ মনে করে আত্মার বন্ধন মুক্তি এবং স্বরূপে অবস্থান। কেউ আবার বলেন দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। চার্বাকরা এর কোনটিই মেনে নেন নি। তাদের মতে,
মুক্তির জন্য সকল প্রকার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা অযৌক্তিক এবং বৃথা।
৮. নৈতিকতা সম্পর্কিত মতবাদ : চার্বাকরা ইন্দ্রিয় সুখকে মানসিক সুখের তুলনায় অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছেন। যথাসম্ভব দুঃখ পরিহার করে সর্বাধিক পরিমাণ ইন্দ্রিয় সুখলাভ করাই মানবজীবনের চরম লক্ষ্য। যে কাজে দুঃখের তুলনায় সুখ বেশি, সে কাজ ভালো। আর যে কাজে সুখের তুলনায় দুঃখ অধিক সে কাজ মন্দ ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, চার্বাক দর্শনই ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভারতীয় দর্শনকে নির্বিচারবাদের হাত থেকে রক্ষ া করেছে। চার্বাকরা গতানুগতিক চিন্তাধারাকে বিনা বিচারে স্বীকার করে না নিয়ে স্বাধীন চিন্তার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পরবর্তীকালে অন্যান্য ভারতীয় সম্প্রদায় নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চার্বাক মতবাদ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন।