অথবা, উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে এ গোষ্ঠীগুলো কী কী ভূমিকা পালন করে আলোচনা কর।
অথবা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা আলোচনা কর ।
অথবা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : “The interest groups is strong and effective when it has a directed specific purpose.”
আধুনিক সমাজে এমন অনেক সংগঠন, গোষ্ঠী বা দল লক্ষ্য করা যায়, যার সদস্যরা নির্দিষ্ট স্বার্থের রন্ধনে পরস্পর সংযুক্ত এবং তারা সরকারি কার্যকলাপ, নীতি ও সিদ্ধান্তকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে থাকে। এ ধরনের সংগঠন বা গোষ্ঠীকে Pressure group বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলা হয়। আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় Pressure group বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে একটি শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ তথা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। মানবজীবনের পরিপূর্ণ বিকাশে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা বা কার্যাবলি (Role or functions of interest groups) : আধুনিক শাসনব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সমাজব্যবস্থা মূলত বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী বা স্বার্থকামী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত এবং এরা সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট থাকে। নিম্নে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা বা কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :
১. আইন ও শাসন বিভাগের উপর প্রভাব : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো সরকার গঠনে সচেষ্ট না হয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। তাছাড়া এ প্রচেষ্টা আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ উভয়ের মধ্যে
কেন্দ্রীভূত থাকতে পারে। আইন ও শাসন বিভাগের প্রতিপত্তি সমপর্যায়ভুক্ত হলেও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রভাব শাসন বিভাগের উপর অধিক মাত্রায় প্রতিফলিত হয়। আবার আইনসভার বিভিন্ন কমিটির কাছে স্বার্থকামী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের
বক্তব্য তুলে ধরে ও আইন প্রণয়ন কিংবা পরিবর্তন সাধনে সচেষ্ট হয়।
২. বিচার বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার : বিচার বিভাগও Pressure group এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রধানত দু’টি উপায়ে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের উপর প্রভাব বিস্তার করার প্রয়াস পায়।
প্রথমত : বিচারপতি নিয়োগের সময় প্রতিটি গোষ্ঠী নিজেদের সমর্থকদের মধ্য থেকে যাতে বিচারপতি নিযুক্ত হন।
সেজন্য চেষ্টা করেন। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের “The American Bar Association’,
দ্বিতীয়ত : অনেক সময় আইনের প্রশাসনিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে
বক্তব্য রেখে Pressure groups বিচারপতিদের রায়পানকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
৩. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজের উপর প্রভাব : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনে এমনভাবে প্রচারকার্য চালায় যাতে
করে সমর্থিত দল জয়লাভ করে। আবার প্রতিদ্বন্দ্বী দল জয়লাভ করলেও তেমন কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনে তারা নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্রতী থাকে। কখনো কোন দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে
সচেষ্ট থাকে।
৪. জনসংযোগ সাধনের ক্ষেত্রে: উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সংযোগ সাধনে সাহায্য করে।অপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য সংযোগ সাধনের উদ্যোগ ভ্যাগ করতে পারে না। গণসংযোগের মাধ্যমে এরা জনগণের কাছে নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা ও সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী নীতির সমালোচনা করে। আবার অনেক সময় সরকারের পক্ষেও প্রচারকার্য চালায়।
৫. উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি : উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কার্যকারিতার জন্য বিশেষ সহায়ক। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজেদেরকে সুসংগঠিত করতে পারে। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
৬. সমাজ গঠনে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা : যে কোন দেশের আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বর্তমানে অব্যাহতভাবে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এ অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের এ প্রভাবকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের অনুকূলে সমাজ গঠনের চেষ্টা করছে। Prof. Finer তাই বলেছেন, “চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর স্বীকৃতি বর্তমানে সরকার ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। “
৭. রাজনৈতিক কৃষ্টির উপর প্রভাব : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক কৃষ্টির উপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। রাজনৈতিক কৃষ্টি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অনুকূলে হলে তাদের পক্ষে দাবিদাওয়া আদায় করা সহজ হয়।
৮. বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবেশ গঠন : বর্তমানে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পক্ষে প্রতা প্রচারকার্য চালিয়ে সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী জাতীয় দাবি, স্বার্থ ও মূল্যবোধের সাথে একটি কার্যকরী সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।
৯. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর প্রভাব : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে সচেষ্ট হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো আইন ও শাসন। বিভাগকে প্রভাবিত করে নিজ নিজ গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হন।
১০. সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরকারের উপদেষ্টার ভূমিকাও গ্রহণ করে। কেননা বর্তমানেও সরকার বিশেষ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন এবং ব্যবস্থা গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে। য ফলশ্রুতিতে সরকার গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি বক্তব্যের মাধ্যমে আইন অথবা সিদ্ধান্তকে ত্রুটিমুক্ত করার সুযোগ পায়।
১১. সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি দূরীকরণের ক্ষেত্রে: চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রশাসনের দক্ষতা বজায় রাখা এবং ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করতে সাহায্য করে। এ গোষ্ঠী সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এর ফলে সরকার নিজের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন থাকে।
১২. তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভূমিকা : চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সংবাদ এবং তথ্য সংগ্রহের অন্যতম উৎস। সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আইনসভার সদস্য, আমলা, সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের উচ্চতর পর্যায়েও তথ্য সরবরাহ করে। তাছাড়া এরা জনসাধারণের কাছেও বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা করে। যে কারণে পুস্তিকা প্রকাশ, জনসভা, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী তাদের বক্তব্য পেশ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক সমাজব্যবস্থা মূলত বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এরা সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, কার্যকর এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকূলে প্রবাহিত করতে সচেষ্ট থাকে। যদিও সরকার গঠন করা তাদের কাজ নয় তবুও সরকারি সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের স্বার্থের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। তাই Alan. R Ball যথার্থই বলেছেন, “চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং অনড়।