চল বলতে কি বুঝ? মনোবিজ্ঞানের পরীক্ষণে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার চল এর বর্ণনা দাও।

অথবা, চল কাকে বলে? চল এর শ্রেণীবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, চলের সংজ্ঞা দাও। চলের শ্রেণীবিন্যাসসহ মনোবিজ্ঞান পরীক্ষণে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার চল আলোচনা কর।
অথবা, চল কী? মনোবিজ্ঞানে চলের প্রকারভেদ আলোচনা কর।
অথবা, চল কী? চলের শ্রেণিবিন্যাস ব্যাখ্যা কর।
অথবা, চল কী? চলের শ্রেণিবিভাজন আলোচনা কর।
অথবা, চল কী? চল কত প্রকার ও কী কী? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : চল একটি বৈজ্ঞানিক শব্দ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে Variable এবং বাংলা অর্থ হল চলনশীল বা পরিবর্তনশীল। সাধারণ অর্থে চল বলতে এমন একটা বৈশিষ্ট্য বা গুণ বুঝায়, যা একই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে।.চল অর্থাৎ, চল মূল্যায়ন পরিবর্তনশীল। একটি পরীক্ষণে অনেকগুলো গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হতে পারে। অতএব চল বলতে আমরা বুঝি যে কোন উপাদান, যা আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাই চল । চল পরীক্ষণের এমন একটা বৈশিষ্ট্য যা ফলাফলের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
চলের সংজ্ঞা : বিশ্ব সংসারে যাবতীয় সবকিছুই পরিবর্তনশীল। মানুষের নিজের বৈশিষ্ট্য যেমন- তার বয়স, বুদ্ধি,মেজাজ, স্বাস্থ্য, আগ্রহ, ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমন-পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, কৃষ্টি, আবহাওয়া, সামাজিক পরিমণ্ডল, আত্মীয়স্বজনদের আচরণ, কর্মজগতের সাফল্য, ব্যর্থতা ইত্যাদি পরিবর্তনশীল। ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক উপাদানগুলোর পরিবর্তনের ফলে ঐ ব্যক্তির আচরণেও
পরিবর্তন দেখা যায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এসব পরিবর্তনশীল উপাদান, বৈশিষ্ট্য বা আচরণকে চল বলা হয়। অর্থাৎ, যা কিছু পরিবর্তনশীল বা যাকে পরিবর্তন করা যায়, তাকেও চল বা ভেদ্য বলা হয়।
চলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে McGuigan বলেছেন, “Anything that can change in value and thus assume different numerical values is variable.”
Postman and Egar বলেছেন , “A variable is a characteristics or attributes that can take on a number of value.”
উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি পরীক্ষণের সাহায্যে দেখতে চাই যে, “সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বেশি তাপমাত্রার কোন প্রভাব রয়েছে কি না।” তাহলে কম তাপমাত্রা এবং বেশি তাপমাত্রার পরিবেশ সৃষ্টি করে এ দু’পরিবেশে পরীক্ষক দু’দল ছাত্রকে সমস্যা সমাধান করতে দিতে পারেন। এরূপ দু’টি পরিবেশ সৃষ্টি করে সমস্যা সমাধানে ছাত্রদের ভুল গণনা করা মতো পারে। এ ভুলের সংখ্যাগুলোকে আমরা চল বলতে পারি। ভুলগুলোর সংখ্যাকে এজন্যই আমরা চল বলে থাকি।
ভুলগুলোর মূল্যমান পরিবর্তনশীল। যে কোন ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণকারী ঘটনা বিভিন্ন চলের উপর নির্ভরশীল।সহজ কথায় যা পরিবর্তনশীল বা যাকে পরিবর্তন করা যায় তাকে ভেদ্য বলা হয়। যা বিভিন্ন সংখ্যামান গ্রহণ করতে সক্ষম তাকে চল বলা হয়। কিন্তু এখানে একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, মনোবিজ্ঞানীগণ যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তার সাথে সম্পর্কযুক্ত পরিবর্তনশীল বস্তু বা উপাদানই কেবল চল হিসেবে বিবেচ্য। সব পরিবর্তনশীল বস্তু চল নয়। অর্থাৎ, চল হতে হলে এটা পরিবর্তনশীল এবং মনোবিজ্ঞানের গবেষণাগারে পরীক্ষণের বিষয়বস্তু হতে হবে।
মনোবিজ্ঞানীগণ চলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন। নি েএগুলো দেওয়া হল :
১. স্বাধীন বা অনির্ভরশীল চল : যে চল আচরণের উপর প্রতিক্রিয়া করতে নিজেই সক্ষম এবং অন্য কারও উপর নির্ভর করতে হয় না তাকে স্বাধীন বা অনির্ভরশীল বা নিরপেক্ষ চল বলে। অন্যভাবে বলা যায়, যে চলটি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্য কোন চলের উপর নির্ভরশীল না হয়ে কোন একটি চলের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাকে বলা হয় অনির্ভরশীল চল। অর্থাৎ, যে চল অন্য চলের সাহায্য ছাড়া নিজেই আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাকে নিরপেক্ষ বা অনির্ভরশীল চল বলা হয়।পরীক্ষক ইচ্ছানুযায়ী অনির্ভরশীল চল পরিবর্তন করতে পারেন এবং এরূপ পরিবর্তনের ফলে নির্ভরশীল চলের কি প্রতিক্রিয়া হয় তা গবেষণা করেন। প্রাচীন পরীক্ষণ পরিকল্পনায় একটিমাত্র অনির্ভরশীল চল থাকত, কিন্তু আধুনিক উন্নতমানের পরিসংখ্যানের সাহায্যে বর্তমানে একই সাথে একাধিক অনির্ভরশীল চল বা ভেদ্য নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।পরীক্ষক ইচ্ছামতো যে চলের পরিবর্তন ঘটায় সে চলকে অনেক সময় পরীক্ষণমূলক চলও বলা হয়। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় অনির্ভরশীল চল হল প্রাকৃতিক উদ্দীপক, যা ইন্দ্রিয়সমূহের প্রতি আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম। যথা : আলোক রশ্মি, শব্দ তরঙ্গ প্রভৃতি উদ্দীপক অনির্ভরশীল চল ।
২. নির্ভরশীল চল : যে চলকে তার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি হ্রাস বা বৃদ্ধির জন্য নিরপেক্ষ চলের উপর নির্ভর করতে হয় তামে নির্ভরশীল চল বলা হয়। নির্ভরশীল চলের উপস্থিতি ও পরিবর্তন নির্ভর করে অনির্ভরশীল চলের উপস্থিতি ও পরিবর্তনের উপর। অনির্ভরশীল চল পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাণীর আচরণের যেসব পরিবর্তন ঘটে সেগুলোকে বলা হয়।নির্ভরশীল চল। অর্থাৎ, যে চলকে সৃষ্টির জন্য অন্য কারও উপর নির্ভর করতে হয় তাকে নির্ভরশীল চল বলা হয়।
মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় জীবের প্রতিক্রিয়া বা সাড়া হচ্ছে নির্ভরশীল চল।
উদাহরণস্বরূপ, একটি কবিতা যত বেশি বার আবৃত্তি করা হয়, তত বেশি, মুখস্থ হবে। কবিতাটির কতটুকু মুখস্থ হল তা নির্ভর করে কতবার আবৃত্তি করা হয়েছে তার উপর। সুতরাং, মুখস্থ করার পরিমাণ হল নির্ভরশীল চল।
৩. যোগ সাধনকারী বা মধ্যবর্তী চল : অনির্ভরশীল এবং নির্ভরশীল চল ছাড়াও আরও এক প্রকার চল আছে এটাকে মধ্যবর্তী চল বলা হয়। তার কারণ এটা নির্ভরশীল ও অনির্ভরশীল চলের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে উভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। যেমন- বয়স, অভ্যাস, প্রেষণা ইত্যাদি। এটা একটি জৈবিক চল যাকে সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। শুধু এর কার্যফল পর্যবেক্ষণ করা যায়। ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্যের কারণেও আচরণের পার্থক্য সৃষ্টি হয়।
আবার শারীরিক অবস্থা, মানসিক অবস্থা ইত্যাদির তারতম্যের কারণেও আচরণের পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ ও প্রাণীর এসব শারীরিক ও মানসিক চলকে জৈবিক চল বলা হয়। এ চলটিকে সাধারণত প্রকল্পিত ধারণা বলা যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কোন একটি ছেলেকে ৬ ঘণ্টা খেতে দেওয়া হয় না। এ ঘটনা হতে আমরা অনুমান করতে পারি যে,ছেলেটির ক্ষুধা পেয়েছে। এখানে ক্ষুধা হল যোগ সাধনকারী বা মধ্যবর্তী চল।
৪. বাহ্যিক চল : বাহ্যিক পরিবেশ থেকে যে চলের উদ্ভব হয় তাকে বাহ্যিক চল বলা হয় বা পরীক্ষণ বিশ্লিষ্ট চল বলা হয়। এ চলগুলোকে পরীক্ষণ কর্তৃক আরোপিত নয় অথচ এগুলো ঘটনাক্রমে পরীক্ষণের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে।এগুলো ফলাফলের উপর অবাঞ্ছিত প্রভাব বিস্তার করে। বাহ্যিক চল পরীক্ষণের নিরপেক্ষ এবং নির্ভরশীল চলের সাথে সম্পর্কিত হয়। যেমন- গবেষণাগারের তাপমাত্রা, পারিপার্শ্বিক এলাকার গোলমাল, মিছিলের শ্লোগান প্রভৃতি বাহ্যিক চলের উৎপন্ন হবে সে সম্বন্ধে কোন অনুমান করা যুক্তিসংগত হবে না। এজন্য ফলাফলের উপর যাতে বাহ্যিক চল কোন প্রভাব বিস্তারিত করতে না পারে, সেজন্য এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন চল সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে নিয়ন্ত্রিত চল সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন।
৫. নিয়ন্ত্রিত চল : যেসব শর্তের প্রভাব থেকে আচরণ বা পর্যবেক্ষণ ঘটনাকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা হয়, সেসব শর্তকে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত চল। কোন কোন পরীক্ষণে কতকগুলো চলকে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে আগে অন্য কতকগুলো চলকে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করা হয়। যেসব বাহ্যিক চলের প্রভাব থেকে নির্ভরশীল চলকে অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণীয় আচরণকে মুক্ত রাখা হয়, সেগুলোকে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত চল।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, চল মনোবিজ্ঞানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।মনোবিজ্ঞানের যে কোন কর্মকাণ্ডে এবং যে কোন পরীক্ষণে চলের উপস্থিতি খুবই দরকার। মনোবিজ্ঞানের যে কোন কিছুকে ভালোভাবে বুঝতে হলে চল সম্পর্কে অবশ্যই সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। মনোবিজ্ঞানের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে মূল্যবান একটি উপাদান।