অথবা, গ্রিসের দাসপ্রথা পর্যালোচনা কর।
অথবা, গ্রিসের দাসপ্রথা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : দাস প্রথা একটি প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের একটি পর্যায়ে দাসপ্রথার উদ্ভব ঘটে। দাস সমাজ ছিল সর্বপ্রথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। এ সমাজে মালিক শ্রেণী দাসদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতো। দাসপ্রথা তাই সামাজিক ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দাসপ্রথা বেশিদিন স্থায়ী হয়। নি। দাসপ্রথার পতনের মধ্য দিয়ে সামন্তবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটে।
গ্রিসের দাসপ্রথা (Greek slavery) : প্রাচীনকালে কতকগুলো নগররাষ্ট্রের সমন্বয়ে গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠে।
গ্রিক নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে স্পার্টা ও এথেন্স ছিল প্রধান। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা দাসপ্রথার উপর ভিত্তি করে গড়ে গ্রিসের অর্থনৈতিক উন্নতি এ দাসপ্রথার উপর নির্ভরশীল ছিল। দাস শ্রমকে কাজে লাগিয়ে গ্রিক অর্থনীতি সমৃদ্ধি লাভ করে । নিম্নে গ্রিসের দাসপ্রথার কতকগুলো দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, গ্রিকরা আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য দাস রাখত। অভিজাত গ্রিকরা ৪০টি পর্যন্ত দাস রাখত। অভিজাতদের সমস্ত কাজকর্ম সম্পাদন, সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের জন্য দাস রাখা হতো।
দ্বিতীয়ত, দাসরা কায়িক পরিশ্রম করত বিধায় দাস সংগ্রহের জন্য যুদ্ধ করা হতো। যুদ্ধে বন্দিদেরকে দাসে পরিণত করা হতো।
তৃতীয়ত, দাসদের অন্যান্য পণ্যের ন্যায় কেনাবেচা করা হতো। তাদের ক্রয়বিক্রয়ের জন্য বাজার গড়ে তোলা হয়। এ সমস্ত বাজারে দিনে এক হাজার পর্যন্ত দাস ক্রয়বিক্রয় করা হতো।
চতুর্থত, দাসদেরকে নিজস্ব কাজে ব্যবহার করা হতো। আবার নিজের কাজ না থাকলে দাসদের ভাড়া প্রদানের ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল।
পঞ্চমত, দাসদের সব ধরনের কাজে অংশগ্রহণ করতে হতো। সমাজের দীনতম নাগরিকেরও দু’টি পর্যন্ত দাস ছিল।
দাস সংস্কার ভিত্তিতে সমাজে আভিজাত্য নির্ণীত হতো।
ষষ্ঠত, দাসদেরকে খনির কাজে নিয়োগ করা হতো। গ্রিসের খনির কাজে প্রায় বিশ হাজার দাস নিয়োজিত ছিল। খনিতে তাদেরকে কঠোরভাবে কাজে লাগানো হতো। একটানা দশ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদেরকে কাজ করতে হতো। বিরাট বিরাট আকরিক লোহা তারা কঠোর শ্রমের মাধ্যমে খনি থেকে বের করত এবং সেগুলো শাবল দিয়ে ভাঙতে হতো। কেউ পালাতে না পারে তার জন্য পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হতো।
সপ্তমত, কলকারখানাতে দাসদের নিয়োগ করা হতো, ছোটবড় সকল ধরনের কলকারখানায় তাদেরকে কাজ করতে
হতো। বৃহৎ কারখানায় ১২০ জন পর্যন্ত দাস নিয়োগ করা হতো।
অষ্টমত, গ্রিক সভ্যতায় দাসদের ভরণপোষণের জন্য খুব কম অর্থই ব্যয় করা হতো। যন্ত্রপাতির ব্যবহার তখনও
প্রচলিত হয় নি। দাসদের কঠোর শ্রমে৷ উৎপাদন পরিচালিত হতো।
নবমত, গ্রিসে দাস ছিল সহজলভ্য। দাস শ্রমকে কাজে লাগিয়ে গ্রিকরা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করে। দাসদেরকে গ্রিকরা ইচ্ছামতো কাজে নিয়োগ করত। তারা বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন করে নি।
দশম, দাসদেরকে শিল্পকারখানা, ব্যবসায় ক্ষেত্রে, অফিসে কেরানি পদ প্রদান করা হতো। অর্থাৎ সর্বনিম্ন স্তরে ছিল তাদের অবস্থান।
দাসপ্রথা সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিকদের অভিমত (Greek philosopher view in slavery) : প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা দাস শ্রমের উপর টিকে ছিল। গ্রিসের অর্থনৈতিক মূল অবলম্বন ছিল এ দাস। তৎকালীন গ্রিক দার্শনিকরা দাসপ্রথা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। প্লেটো দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।
এরিস্টটল দাসপ্রথার পক্ষে কথা বলেছেন। এরিস্টটলের ভাষায়, “কেউ শাসন করবে কেউ শাসিত হবে- এ অবস্থা শুধু অপরিহার্য নয়, উপযুক্তও বটে; জন্মলগ্নেই কেউ শাসন করার জন্য এবং কেউ শাসিত হওয়ার জন্য চিহ্নিত হয়ে গেছে।” কাজেই একথা স্পষ্ট যে, কিছু লোক স্বভাবত স্বাধীন এবং কিছু লোক স্বভ
াবত ক্রীতদাস । শেষোক্ত লোকদের জন্য
ক্রীতদাস ন্যায়সংগত ও উপযুক্ত। তবে এরিস্টটল দাসদের প্রতি দাস মালিকদের দয়ালু হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি অন্যতম ধরন হচ্ছে দাসপ্রথা। দাসপ্রথার মধ্যে সামাজিক স্তরবন্যিাসের একটি সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রিসের দাসপ্রথা ছিল অমানবিক, কঠোর ও নিষ্ঠুর। সমাজের অসহায় মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করে গ্রিক সভ্যতা টিকে ছিল। দাসদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে গ্রিক সভ্যতা
টিকে থাকলেও ভ্যতা এগিয়ে নিতে দাস শ্রমের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বর্তমানে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্ববাসী সোচ্চার।