গ্রামীণ সমাজে বিবাহের ধারা কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে? বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজে বিবাহের পরিবর্তিত ধারা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজে বিবাহের ধারা কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : পরিবার গড়ার জন্য বিবাহ হচ্ছে একটি মৌলিক বিষয়। বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। সামাজিক অনুষ্ঠান, আইন ও নানা নীতি, ধর্ম, রীতিনীতির মাধ্যমে নারী-পুরুষের এ সম্পর্ক
রক্ষা করা হয়। যেহেতু মানবসমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধি বা প্রজনন একটি বিবাহভিত্তিক ব্যাপার, সেহেতু বিবাহকে একটি প্রজনন পরিবার স্থাপনের সমাজ স্বীকৃত পন্থা বলে বর্ণনা করা হয়। গ্রামীণ সমাজের বিবাহ রীতি বা ধারায় পরিবর্তন : সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। সকল সমাজেরই একটি
সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো পরিবর্তন। গ্রামীণ সমাজ এবং গ্রামীণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- বিবাহের রীতি বা ধারা (Pattern) পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, বিবাহের ক্ষেত্রে দেশ-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন রীতিনীতি বর্তমান। আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে গ্রাম সমাজের বিবাহের পরিবর্তন রীতি (Changing pattern) ব্যাখ্যার প্রয়াস পাই। বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে প্রধানত হিন্দু ও মুসলমান এ দুই সম্প্রদায়ের লোক বাস করে থাকে। উভয় সমাজের বিবাহ রীতি কিছুটা আলাদা ধরনের।
আমাদের গ্রামীণ সমাজে একক বিবাহ রীতিই প্রচলিত, তবে কিছু কিছু মুসলিম সমাজে বহুবিবাহ যেমন- একজন পুরুষ একের অধিক মহিলাকেও বিবাহ করে থাকে। গ্রাম সমাজে এখনও বর ও কনের অভিভাবকের মতামতের উপর
নির্ভর করে শুভ কার্য সুসম্পন্ন হয়। তবে আগের দিনে বিয়ের প্রস্তাব, পাত্রপাত্রী দেখা, আদর-আপ্যায়ন এবং বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যতসব আচার অনুষ্ঠান পালন করা হতো তা কিছু কিছু বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আগের দিনে বিয়ে না – হওয়া পর্যন্ত পাত্রী পাত্রপক্ষের দেওয়া গহনা ও কাপড় পরত না। এখন পাত্রীরা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেই পাঠানো কাপড় পরে এবং কস্মেটিক্স ব্যবহার করে।বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে অদ্যাবধি চিরকুমার বা চিরকুমারীর সংখ্যা অতিশয় নগণ্য। এতে প্রমাণিত হয় যে, বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের প্রায় সবাই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। পূর্বের বাল্যবিবাহ প্রথা আজকাল নিয়মের ব্যতিক্রম
হিসেবেই কেবল টিকে আছে। গ্রামে অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কৃষক পরিবারে পুরুষের গড় বিবাহের বয়স ২০ বছর এবং মেয়েদের ১৫ বছর। ইদানীং গ্রাম অঞ্চলে প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে এবং যৌতুক প্রথা উদ্ভব ও প্রসারের কারণে
অনেক পিতামাতাই তাদের কন্যা সন্তানের বিবাহ দিতে বেগ পাচ্ছেন এবং পাত্রীর বয়স বেড়ে যাচ্ছে। অপরপক্ষে, পাত্র ও জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে না দুশ্চিন্তায় বিয়ের বয়স বাড়িয়ে ফেলছে। অবশ্য গ্রামীণ সমাজে পাত্রপাত্রী
উভয়পক্ষই আজকাল অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও বিয়ের গড় বয়স একটু বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের দিনে কেবল হিন্দু সমাজে যৌতুক প্রথা ছিল। পাকিস্তান আমল থেকেই মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথার প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে কন্যা পণ (Bride wealth) সম্পূর্ণ অচল। কন্যা পণের বদলে গ্রামাঞ্চলে আজকাল বর পণ বা যৌতুক চাহিদা খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রেমপরিণয়ের সংখ্যা খুবই কম। তবে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের একটি নগণ্য অংশ গ্রামীণ পরিবার জীবনে প্রেমপরিণয়ে আবদ্ধ হয়। সাধারণত পাত্রপাত্রীর অভিভাবকবৃন্দ নিজেরা অথবা মধ্যস্থতা
রক্ষাকারী ঘটকের সাহায্যে বিবাহের কথাবার্তা এবং চুক্তি সম্পাদন করে। গ্রামীণ সমাজে অসমবর্ণ বিবাহের ঘটনা এখনও সীমিত। ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইন পরিবর্তনের ফলে হিন্দু পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা লক্ষণীয়।
প্রাচীন পারিবারিক মর্যাদার চেয়ে এখন ছেলেমেয়ের বিয়ের সময় পাত্রপাত্রী নির্বাচনে পিতামাতা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক পেশা ও সৌন্দর্য ইত্যাদির উপর বেশি গুরুত্ব দেন। অর্থ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির বলয় বৃদ্ধির কারণেও কিছু পিতামাতা
বিশেষ বিশেষ পরিবারে পাত্রপাত্রীর বিবাহ দিয়ে থাকেন।
ইদানীং গ্রামীণ সমাজে পলিজিনি বা বহু স্ত্রী গ্রহণ প্রথা অনেক কমে গিয়েছে। এর কারণ শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক অসঙ্গতি। অবশ্য একই সাথে একাধিক স্ত্রী রাখার প্রচলন কমে এলেও গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে বারবার বিবাহ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এরা স্ত্রী নিয়ে বেশি দিন ঘর সংসার করছে না বা আর্থিক কারণে পারছেও না। মুসলমান তাঁতি যারা ‘জোলা’ নামে পরিচিতি, তারা তাদের সন্তানসন্ততিদের অন্য কোনো গোষ্ঠীতে বিবাহ দেয় না। এটা অন্তর্বিবাহেরই (Endogamy) সামিল। আধুনিক শিক্ষার আলো বাংলাদেশের গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। কাজেই হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজেই যোগ্য পাত্রপাত্রী হলে আজকাল এসব দিকে তেমন আর লক্ষ্য করা হচ্ছে না। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সুস্পষ্ট। আমাদের গ্রামীণ সমাজে পূর্বের তুলনায় বিবাহবিচ্ছেদ, স্বামী-স্ত্রীর পৃথকাবাস (Separation) বৃদ্ধি পেয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ সমাজে বিবাহের ধারা বা রীতি পরিবর্তন যেন সমাজ পরিবর্তনের নিয়ম মেনে ধীরে ধীরে ঘটে চলেছে। শিক্ষার প্রসার, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গির
সংস্কার প্রভৃতি কারণে গ্রামীণ সমাজে এসেছে সুস্পষ্ট পরিবর্তন আর এ পরিবর্তনের ছোঁয়া আবশ্যি ভাবে লেগেছে গ্রামীণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান বিবাহ ব্যবস্থায়। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, গ্রাম সমাজের বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন একটা চলমান প্রক্রিয়া এবং এ পরিবর্তন ধারা সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ জীবনে প্রভাব রাখছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়,
এ পরিবর্তনের গতি বা ধারা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। ফলে গ্রামীণ সমাজকাঠামোতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন অনিবার্য।