গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব কতখানি? আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব উল্লেখ কর।
অথবা, বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সবিস্তারে তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বে সমাজবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। কি উন্নত, কি অনুন্নত সকল দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, সকল অঙ্গনেই সমাজবিজ্ঞান আজ বিশেষ সমাদৃত এবং দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সকল অঙ্গনেই সমাজবিজ্ঞান তার গতি অব্যাহত রেখেছে বলেই এটি বিভিন্ন শাখায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানও এরই একটি সংস্করণ। গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান হচ্ছে গ্রামের সমাজের বিজ্ঞান। গ্রামের সমাজকে জানা ও বুঝাই হচ্ছে এ বিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব ; সমাজবিজ্ঞানের একটা আলাদা শাখা হিসেবে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের
লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামের সমস্যাসমূহ উদঘাটন করা। শুধু সমস্যা উদঘাটন করাই নয়, তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করে প্রতিকারের দিক নির্দেশনা দেওয়া। গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিয়ম ও নীতির অধ্যয়ন এবং সেগুলো ব্যবহৃত হবে শুধু গ্রামীণ সমাজের সমস্যার সমাধানকল্পে। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করে। আমাদের গ্রামগুলো বড়ই অবহেলিত এবং বিভিন্ন সমস্যায় ভরপুর।
তাই গ্রাম সমাজের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন ও তার সমস্যার সমাধানের সঠিক পন্থা নিরূপণ করা আবশ্যক। গ্রামনির্ভর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব নিম্নে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো :
১. গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান : গ্রামীণ সমাজকে জানা ও বুঝাই হচ্ছে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান পাঠের মৌলিক বিষয় । বাংলাদেশ গ্রামের দেশ। প্রায় ৮৬ হাজার গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ এখনও গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গ্রামগুলোর উপর নির্ভরশীল। গ্রামগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত বা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান (Rural Sociology) অধ্যয়ন করা প্রয়োজন ।
২. উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ : গ্রামগুলোর প্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে গ্রাম্যবিধি অনুসারে কাজ করা প্রয়োজন। কেবল তখনই গ্রাম্য বা পল্লিউন্নয়ন চিরস্থায়ী হতে পারে, যখন গ্রামীণ জনসমষ্টি সকলে একমত হয়ে এবং নিজের মনে করে উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করবে। এর জন্যই প্রয়োজন গ্রাম সমাজকে বিশেষভাবে অধ্যয়ন করা।
৩. শিক্ষা ও গবেষণা : জনগণের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সহযোগিতা ও গবেষণা কেন্দ্রসমূহের সহায়তায় এ বিষয়টির কলেবর দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা সত্যিকারভাবেই স্বীকার করতে হয়, কোন জাতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তার গ্রাম সমাজকে উন্নত করা। এছাড়া গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের প্রায়োগিক অধ্যয়ন একজন শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার গঠনে ভূমিকা রাখে।
J. B. Chitambar এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “The subject is a part of the student’s general education. The subject can provide beginning professional training for a future career.” (P. 13).
৪. গ্রামীণ পুনর্গঠন : গ্রামীণ সমস্যাসমূহ সমাধানের মাধ্যমেই সম্ভব হবে গ্রামীণ পুনর্গঠন ও উন্নয়ন। উদ্ভূত সমস্যা সমাধান ছাড়া কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। একজন সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের কর্তব্য তার সমাজের সংস্কার ও পুনর্গঠন করা, ঠিক তেমনি গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানীদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছেগ্রাম সমাজের সংস্কার ও পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করা।
৫. জাতীয় জাগরণ অর্জন : বাংলাদেশের অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক নয়, বরং মৌলিকভাবে কৃষিভিত্তিক। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকই গ্রামের বাসিন্দা। তাই গ্রামীণ সমাজকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার না করে জাতীয় জাগরণ অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব নয় । এজন্য গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন।
৬. গ্রামীণ সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রাখা : বিদেশি সংস্কৃতির স্রোতে বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি মুছে যাচ্ছে। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন গ্রামের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ধরে রাখতে।
৭. পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন : যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে তার সঠিক নীতিনির্ধারণ করা প্রয়োজন। পরিবার পরিকল্পনা প্রণয়নে আমাদের গ্রামের মানুষেরা এখনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না। সরকারি, বেসরকারি কর্মী যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে নিযুক্ত আছেন, তাদেরকে অবশ্যই
গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে।৮. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : শিল্পায়ন ও শহরায়নের ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ সমাজকাঠামো, চালচলন, আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর বিশেষ প্রভাব পড়ছে। আর এসব প্রভাবের ফলে গ্রামীণ জীবনে এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নিয়ে যেটুকু চিন্তাভাবনা হচ্ছে তাও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হচ্ছে না। এসব সমস্যার আশু সমাধানের জন্য
গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব দিনদিন বেড়ে চলেছে।
৯. অসমতা দূরীকরণ : শিল্পবিপ্লবের ফলশ্রুতিতে এবং শহরায়নের ফলে প্রগতিশীল দেশগুলোতে গ্রামীণ জীবন সাধারণ সমাজ জীবন থেকে পিছিয়ে আছে। গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানীদের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রাম ও নগরের মধ্যকার সাংস্কৃতিক অসমতাকে দূর করে দু’টি সমাজকে সমতায় আনা। কারণ গ্রাম সমাজবিজ্ঞানের লক্ষ্য গ্রাম সমাজের তাত্ত্বিক অধ্যয়ন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে আমরা বলতে পারি যে, বর্তমান বিশ্বে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের লক্ষ্য বিভিন্নমুখী। বিশেষ করে যেসব সমাজ প্রাথমিকভাবে গ্রামকেন্দ্রিক, যেমন- বাংলাদেশের সমাজ। বাংলাদেশের মতো গ্রামপ্রধান দেশে গ্রাম সমাজের অধ্যয়ন একান্তই জরুরি। কারণ গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের ফলে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার
সার্বিক দিক সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব। আবার এ সমাজব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে ‘পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নেও সহায়ক হয় গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান।