গ্রামীণ পরিবারে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে? বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ পরিবারের পরিবর্তনের ধারা আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ পরিবারের পরিবর্তিত ধারা সম্পর্কে আলোচনা কর ।
অথবা, গ্রামীণ পরিবারে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : বাংলাদেশ গ্রামের দেশ। প্রায় ৮৬ হাজার গ্রাম নিয়ে এ দেশ। গ্রাম বলতে আমরা সাধারণত বুঝে থাকি কৃষিকে কেন্দ্র করে যে জনসমষ্টি গড়ে উঠে। পরিবার গ্রাম সমাজের কেন্দ্র, কারণ পরিবারকে ঘিরেই গ্রাম
সমাজের সকল বিষয় আবর্তিত হয়। কিন্তু কৃষিবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রগতি এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ পরিবারগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায় এ পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। গ্রামীণ পরিবারে পরিবর্তন : বস্তুত গ্রামীণ পরিবারগুলোর মধ্যে পরিবর্তনের প্রবণতা অত্যন্ত কম। কালের নিয়মে গ্রামীণ পরিবারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। নিম্নে এ পরিবর্তনের Pattern বা ধারা বর্ণনা করা হলো :
১. পরিবারের আকারের পরিবর্তন: শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যেহেতু কর্মসংস্থানের কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি করেছে, সেহেতু গ্রামের যৌথ পরিবার থেকে অনেকে নগরে কাজ করতে গিয়ে একক পরিবার গড়ে তুলছে। যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা
দিয়েছে। এজন্যই পরিবারের আকার এবং কাঠামোয় এসেছে পরিবর্তন।
সমাজবিজ্ঞান (ডিগ্রি-৬ষ্ঠ পত্র।-৩১
২. অর্থনৈতিক কাজে পরিবর্তন : বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে পরিবারগুলো ডুকেন্দ্রিক বা ভূমিনির্ভর হওয়ায় পরিবারস্থ লোকদের ভৌগোলিক সচ্ছলতা হ্রাস পায়। এখানে কৃষিকাজ ছাড়া এখনও অনেক পেশাভিত্তিক পরিবার রয়েছে, যেমন- তাঁতি, জেলে, কুম্ভকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, কামার, গোসালা ইত্যাদি। এসব লোকদের মধ্যে পেশা পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শিল্পায়িত সমাজের পরিবারের তুলনায় গ্রামের পরিবারগুলো উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে বেশ নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক পরিবর্তনের আর একটি দিক হলো এখন গ্রামগুলোতে ক্রমশ ছোট ছোট শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত
হচ্ছে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকরা কৃষির উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে চাকরিবাকরি বা ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা
অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় পরিবর্তন ঘটছে।
৩. সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন: গ্রাম সমাজে পরিবারের অন্যতম বিশেষত্ব এ যে, পরিবারস্থ শিশুরা অগ্রজদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে থাকে। এর ফলে তাদের উপর অগ্রজদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত দেখা যায়, গ্রামীণ
পরিবারগুলোতে শিশু-কিশোরদের আচারব্যবহার ও শিক্ষাদীক্ষা পিতামাতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের উপর নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু আজকাল শিক্ষাব্যবস্থা বেশ জটিল রূপ ধারণ করায় গ্রামীণ সমাজেও শিক্ষা দানের কাজটি পরিবারের বাইরের শিক্ষালয়গুলো, যেমন- স্কুল, কোচিং সেন্টার, কিন্ডার গার্টেন প্রভৃতি গ্রহণ করেছে। এতিম শিশুদের জন্য এতিমখানা, অনাথ
আশ্রম প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া গ্রামে মেয়েদের ভিতর শিক্ষার প্রসারের ফলে গ্রামীণ নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৪. অবকাশরঞ্জক কাজে পরিবর্তন : পূর্বে গ্রামীণ পরিবারের সদস্যদের অবসর বিনোদনের একমাত্র ক্ষেত্র ছিল পরিবার। বর্তমানকালে গ্রামীণ সমাজে পরিবারের বাইরে অবকাশ রঞ্জনের বহুমুখী ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। খেলার মাঠ,
হাটবাজারে গল্পগুজব, সিনেমা, রেস্তোরাঁ প্রভৃতিতে আজকাল গ্রামীণ পরিবারের সদস্যরা অবসর সময় কাটায়। যদিও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার একদিকে গ্রামের পরিবারগুলোর অবকাশ রঞ্জক কার্য গ্রহণ করেছে, অন্যদিকে, আবার
রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতির মতো জিনিস সরবরাহ করে পরিবারের হাতেই এ কার্যকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
৫. পরিবারের রাজনৈতিক ভূমিকায় পরিবর্তন : গ্রামীণ সমাজে পরিবার ছাড়াও রাজনৈতিক শিক্ষা দানের জন্য প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। তথাপি নিয়ম শৃঙ্খলা, অধিকার, কর্তব্য ও নেতৃত্বের মূল ধারণা পরিবারেই দেওয়া হয়।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কাজের বিষয়েও একই কথা বলা চলে। বর্তমানে গ্রামীণ পরিবারের রাজনৈতিক কার্য, রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন গ্রহণ করেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফলে পরিবারের রাজনৈতিক শিক্ষায় কিছুটা শিথিলতা এসেছে।
উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ সমাজের রাজনীতি বা Village politics দিনদিন জটিলতর রূপ নিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ পরিবারে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়।
৬. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন : গ্রামীণ সংস্কৃতি ও চিত্তবিনোদন ব্যবস্থা নগর সংস্কৃতির তুলনায় অধিকতর ঐতিহ্যবাহী যাতে আবহমান গ্রাম জীবনের স্বরূপ ফুটে উঠে। গ্রামীণ সমাজে শ্রেণি বৈষম্য তুলনামূলকভাবে কম। তাই এখানকার বিভিন্ন
ধরনের লোক সংগীত, খেলাধুলা ও যাত্রাভিনয়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। আধুনিক গণযোগাযোগ মাধ্যমে নগর সংস্কৃতির প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্রামীণ সংস্কৃতির উপর। ফলে ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি সর্বাই পরিবর্তনশীল রূপ পরিগ্রহ করে।
৭. ধর্মীয় ঐক্যে পরিবর্তন : গ্রামীণ পরিবারের সদস্যগণ সাধারণত একই রকম ধর্মীয় চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। এছাড়া গ্রাম সমাজের নিরক্ষর লোকের সংখ্যা বেশি থাকায় বিধিবদ্ধ প্রাচীন সামাজিক কুসংস্কারগুলো
এখনও টিকে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সচেতনতার প্রভাব গ্রামের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে কিছু কিছু দেখা যায়।
৮. বিবাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন : গ্রামীণ পরিবারের বিবাহ প্রতিষ্ঠানেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাত্রপাত্রী নির্বাচনের সময় পিতামাতা তাদের ছেলেমেয়েদের মতামত গ্রহণ করছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, গ্রামীণ পরিবার মোটেই স্থবির প্রতিষ্ঠান নয়। এর ভিতর গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের গ্রামগুলো এখন একটি ক্রান্তিকালীন পর্যায় অতিক্রম করছে।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, পুরানো সামাজিক সম্পর্ক ও বন্ধন ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। সম্প্রদায়সূচক চেতনা দ্রুত কমে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনে শহরের রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। সমাজ পরিবর্তনে গ্রামীণ পরিবারের ভূমিকা ও কাজের মধ্যে পরিবর্তন আসছে সন্দেহ নেই।