অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কাকে বলে? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদানসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর সংজ্ঞা দাও। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদানগুলো ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কী? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উৎস বর্ণনা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে কী বুঝ? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কী? গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো উপাদান সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৮০% মানুষ গ্রামে বসবাস করে।গ্রামকে কেন্দ্র করেই সমাজে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। এ গ্রামীণ নিম্নবিত্ত মানুষের মুখপাত্র হিসেবেই গ্রামের কিছু ব্যক্তি যারা সম্পদশালী, শিক্ষিত ও ব্যক্তিগত গুণাবলির অধিকারী অথবা বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন এ শ্রেণিকে নিয়েই আমাদের দেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো গড়ে ওঠে।
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যাখ্যা করার আগে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষমতা ও ক্ষমতা কাঠামো কি? তারপর গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সহজ হবে।ক্ষমতা হচ্ছে একপ্রকার শক্তি। আর এ শক্তির মাধ্যমে অন্যের সিদ্ধান্ত, ইচ্ছা, মতামত, এমনকি আচার আচরণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করা যায়। ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলা যায়, যে প্রক্রিয়া দ্বারা অন্যের উপর নিজের সিদ্ধান্ত,ইচ্ছা বা মতামতকে চাপিয়ে দেয়া বা বাস্তবায়ন করা হয়, তাই হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী
কোহেন (Cohen) বলেছেন, “অপরের আচরণকে প্রভাবিত করার সামর্থ্য অথবা অপরের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রভাব অর্জন করাই হচ্ছে ক্ষমতা।”
যে প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতাকে সমাজের মধ্যে প্রয়োগ করা হয়, তাই হচ্ছে ক্ষমতা কাঠামো (Power থেকে ক্ষমতা
structure)। এককথায় ক্ষমতা কাঠামোকে বলা যায় ক্ষমতা প্রয়োগের প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : ড. আতিউর রহমান তাঁর ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের সংগ্রাম’ গ্রন্থে মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোণ কাঠামো সম্পর্কে বলেছেন, “শ্রেণিসমূহের অবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এদের ভূমিকা ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সমাজ সামাজিক শক্তিসমূহ যেসব কাঠামোর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় বা হয়ে থাকে, তাকে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলা হয়।” গ্রামীণ ক্ষমতার প্রয়োগ, ব্যবহার ও বিকাশ মূলত গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামোর মাধ্যমে লক্ষ্য করা যায়। এখানে এলিট শ্রেণি ক্ষমতা চর্চা করেন। সাধারণ জনতার উপর ক্ষমতার প্রয়োগ হয়।
ক্ষমতা কাঠামো এক শ্রেণি নিয়ন্ত্রক বা শাসকের ভূমিকা পালন করে। অন্য শ্রেণি নিয়ন্ত্রিত বা শাসিত হয়। গ্রামীণ সমাজে ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগকে কেন্দ্র করেই গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো (Rural power stucture) গড়ে ওঠে।
Anthony Giddens এর মতে, “যে প্রক্রিয়া দ্বারা মানুষ সামাজিক সংগঠন বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিজস্ব কর্তৃত্ব বা ক্ষমতাকে প্রকাশ করতে চায় বা করে, সেটিই হচ্ছে ক্ষমতা কাঠামো।” (To designate those individuals who occupy positions of authority at the head of social organizations or institutions.)
ওয়েবারের মতে, “গ্রামীণ উৎপাদন যন্ত্র, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় কারা কর্তৃত্ব স্থাপন করবে, কিভাবে এ কর্তৃত্ব বিকশিত হবে এবং ক্ষমতার যেসব উপাদান আছে তা নির্ধারণ করবে, সে উপাদানের সমন্বয়েই হয় গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো।”
গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদান বা উৎস : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো কোনো কোনো উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ প্রসঙ্গে ষাটের দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়। এগুলো হলো :
1.Anthropological; 2. Economical; 3. Sociological.
Bargman and Tim তাঁদের গবেষণার ক্ষমতার- i. অভ্যন্তরীণ এবং ii. বহিঃস্থ এ দুই ধরনের উপাদান লক্ষ করেন।
i. অভ্যন্তরীণ উপাদান : ভূমি মালিকানা, সামাজিক মর্যাদা গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান (পরিবার, তাঁতি বংশ), ইউনিয়ন
পরিষদের নেতৃত্ব, অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নেতৃত্ব, বলপ্রয়োগের সামর্থ্য, শক্তিশালী গোষ্ঠী, বংশগত ঐতিহ্য,সামাজিক ক্ষমতা ইত্যাদি।
ii. বহিঃস্থ উপাদান : রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক, জাতীয় সংসদের স্থানীয় সদস্য, পুলিশ বাহিনী, সমবায় সমিতি গ্রামীণ বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, ঋণ দাতা গোষ্ঠী যেমন- গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, ‘থানা নির্বাহী পর্যায়ের কর্মকর্তার সাথে সম্প ত্যাদি ।
iii. মূলত বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর পশ্চাতে তিনটি উপাদান কাজ করে। যথা :
১. অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি, ২. সামাজিক মর্যাদা এবং ৩. রাজনৈতিক শক্তি।নিম্নে সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদানসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. অর্থনৈতিক সচ্ছলতা : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর প্রধান উপাদান হলো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। কার্ল মার্কস এর
মতে, “সমাজে প্রভাব সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হতে হবে।” গ্রামে বাস্তবিকপক্ষে দেখা যায়, যার অর্থসম্পদ বেশি তার ক্ষমতাও বেশি। গ্রামীণ মানুষ তাদের মান্য করে চলে ।
২. ভূমিমালিকানা : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো একটি স্বাধীন উপাদান হিসেবে ভূমি মালিকানাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যায়। জমি যার শক্তি তার এটাই হলো গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর মূলসূত্র। যার যত বেশি ভূমি আছে, সে তত বেশিদিন মজুরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণেই ড. জিহাদুল করিম এক জরিপে দেখিয়েছেন যে,সমাজে যাদের জমি ২.৫ থেকে ৭.৫ একর পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৫৮% লোক ক্ষমতা কাঠামোর সাথে জড়িত।”
৩. চাকরি : চাকরিজীবীদেরকে গ্রামীণ লোকজন মান্য করে। তারা মনে করে তাদের সাথে শহরের যোগাযোগ বিদ্যমান, তাই তারা ক্ষমতাশালী। আর এ কারণে গ্রামীণ মানুষ বিভিন্ন তথ্য ও খবরাখবর নিতে তাদের কাছে আসে।এক্ষেত্রে চাকরিজীবীরা মিডিয়া ম্যান (Media man) হিসেবে কাজ করে।
৪. শিক্ষা : শিক্ষা বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষিত মানুষকে সকলে মান্য করে, শ্রদ্ধা করে, তাদের সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত উপরে। শিক্ষিত শ্রেণি, গ্রামীণ অম্ল ও নিরক্ষর মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানদান করে এবং গ্রামীণ মানুষ ও বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দ্বারস্থ হয়।
৫. বংশ : গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি নামিদানি বংশের নেতার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নামিদামি বৃহৎ বংশের হচ্ছে ব্যাপক আকারে জনসমষ্টির উপর নিয়ন্ত্রণ। এটি অনেকগুলো গোষ্ঠীর সাথে সংযোগ স্থাপনে বেশ ভূমিকা রাখে। এটিকে ক্ষমতার একটি সনাতন উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
৭. নি ব্যবস্থা : এ ব্যবস্থায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ক্ষমতা কাঠামোর একটি ক্ষয়িষ্ণু প্রতিষ্ঠান। এক সময় গ্রামীণ সমাজে ঋণ দাতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল, যা আশির দশকে ক্রমান্বয়ে অনেক হ্রাস পায়। এ প্রক্রিয়া গ্রামীণ সমাজে এখনও দেখা গেলেও এটা তার প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র হারিয়েছে।
৮. নিজস্ব গুণাবলি : যদি কেউ ব্যক্তিগত গুণাবলির জন্য গ্রামে সুপরিচিত হয়, তাহলে গ্রামের লোকজন তাকে শ্রদ্ধা
করেও মেনে চলে। নিজস্ব গুণাবলির সাহায্যেই মানুষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে।
৯. রাষ্ট্রের সাথে যোগসূত্র : রাষ্ট্র গ্রামীণ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দমনমূলক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্র
নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
১০. সমাজ নেতৃত্ব : সমাজ হলো একটি সনাতন গ্রামীণ প্রতিষ্ঠান, যার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন গ্রামের প্
রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যারা বিশাল ভূমির মালিক। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সাধারণত ‘মাতব্বর’,’সরদার’, ‘প্রধান’ কিংবা প্রামাণিক ইত্যাদি নামে এলাকাভেদে পরিচিত। অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রেই তারা এ নেতৃত্বটা ভোগ করে থাকেন।
১১, ধর্ম : ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করার মাধ্যমে মৌলবি, মোল্লা, পুরোহিত ব্রাহ্মণ হলে ধর্ম অনেক সময় গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে মৌলবি, মোল্লা, পুরোহিতরা অদৃশ্য ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকে।
১১, জ্ঞাতি সম্পর্ক : বংশের মত জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সম্পর্কও গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর ভিত্তি
হলো বৈবাহিক সংযোগ। বিভিন্ন জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সমর্থন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যাদের আত্মীয়স্বজন চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো ক্ষমতায় থাকে তারাও সে বলে ক্ষমতা ব্যবহার করে থাকে।
১২. স্থানীয় সংগঠন : সমবায় সমিতি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, গ্রাম পরিষদের সদস্যসমূহ ইত্যাদি গ্রামীণ ক্ষমতার অতিরিক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। গ্রামীণ পর্যায়ে এ কাঠামো স্থানীয় ক্ষমতাকে জনকল্যাণে যেমন ব্যবহার করছে, তেমনি নিজেদের স্বার্থেও ব্যবহার করছে।